সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ২২ মে#
৯ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীর বিষয়ে সভা করা নিয়ে আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল জেএনইউ, তার পরিপ্রেক্ষিতে জেএনইউ কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে শাস্তি দিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন দক্ষিণপন্থী, বাকিরা বামপন্থী বলে পরিচিত।
শাস্তির বহরটা এরকম — কাশ্মীরি ছাত্র মুজিব গাত্তু-র ২ সেমেস্টার সাসপেনশন। উমর খালিদের ১ সেমেস্টার সাসপেনশন ও বিশ হাজার টাকা জরিমানা। অনির্বান ভট্টাচার্যের ১৫ জুলাই অবধি সাসপেনশন। তারপর ১৫ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই অবধি তার কোনো শাস্তি নেই। ওই সাতদিনের মধ্যে সে পিএইচডি থিসিস জমা দিতে পারে। কিন্তু না পারলে হয়ে গেল। তারপর থেকে পাঁচ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে না আসার নির্দেশ। বাকি চোদ্দ জন ছাত্রছাত্রীর আর্থিক জরিমানা দশ-বিশ হাজার টাকার। দু-জনকে (আশুতোষ কুমার ও কোমল মোহিতে) হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ, যথাক্রমে এক বছর ও তিনমাসের জন্য। দু-জন প্রাক্তন ছাত্রী — বনজ্যোৎস্না এবং ধ্রুপদীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি না মাড়ানোর নির্দেশ।
এই শাস্তির বিরুদ্ধে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বসহ বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী (১৯ জন) অনশনে বসে। ২৮ এপ্রিল থেকে চলা অনশনে শিক্ষক ইউনিয়নের কয়েকজন সামিল হয় মে মাসের সাত তারিখ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একবার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। উপাচার্যের কথা সন্তুষ্ট হয়ে এবিভিপি অনশন তুলে নিলেও বামপন্থী ছাত্রছাত্রীরা তা তুলতে অস্বীকার করে। যদিও অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে কানহাইয়া কুমার ও উমর খালিদ সহ বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
অপরদিকে ছাত্রদের অনশন যখন চলছিল, সেই সময় দিল্লি হাইকোর্টে একটি মামলা করা হয় শাস্তির বিরুদ্ধে। ছাত্র ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট কানহাইয়া কুমার, চিন্টু কুমারী সহ বেশ কয়েকজন মামলাটি করেছিল। এছাড়া উমর খালিদ ও অনির্বান ভট্টাচার্য-ও শাস্তির বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। ষোলো দিন অনশন চলার পর হাইকোর্ট বলে ছাত্রদের অনশন তুলে নিতে। ছাত্ররা তাতে সাড়া দিলে হাইকোর্ট শাস্তির বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেয়।
সামাজিক ন্যায়পন্থী ছাত্রদের সঙ্গে বামপন্থী ছাত্রদের বিতর্ক
এরই মধ্যে ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং ছিল। সেখানকার আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে শাস্তির বিষয়টা ছিল না। ছিল ওবিসি ছাত্রছাত্রীদের ছাড়, ভাইভা ভোসি পরীক্ষার নম্বর কমানোর বিষয়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক ন্যায়পন্থী ছাত্রছাত্রীদের দীর্ঘদিনের ইস্যু এগুলো। কিন্তু বাইরে ছাত্রছাত্রীরা এবং কাউন্সিলের ভেতরে শিক্ষক প্রতিনিধিরা ছাত্রছাত্রীদের শাস্তির বিষয়ে আলোচনা করার জন্য চাপ দিতে থাকে। উপাচার্য মিটিং বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এতে ক্ষুদ্ধ হয় সামাজিক ন্যায়পন্থী ছাত্রছাত্রীরা। ওইদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ন্যায়পন্থী ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন বাপসা (বিরশা আম্বেদকর ফুলে স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন) র রাহুল সোনপিম্পলে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন শিক্ষক ইউনিয়ন এবং অনশন আন্দোলনকারীদের তুলোধনা করে বক্তব্য রাখে এই নিয়ে। তাতে রাহুল অভিযোগ জানায়, ‘যারা অনশনে বসেছিল, তাদের মধ্যে কতজন জানত যে তাদের বন্ধুরা গেছে কোর্টে বিচার পাওয়ার আশায়? যদি তোমাদের কোর্টের ওপর এতই ভরসা থাকে, তাহলে কোর্টেই যাও বিচারের আশায়, অনশনের নাটক কেন?’ এতে আরো অভিযোগ করা হয়, দলিতরা দেশের বিভিন্ন জেলে বিনা কারণেই বন্দী হয়ে রয়েছে, দেশদ্রোহিতার কেস দেওয়া হয়েছে তাদের ওপর। এরকম হাজার লক্ষ দলিত জেল-এ থাকলেও বড়ো কোনো আন্দোলন হয় না, মিডিয়ায় লেখালেখি হয় না। কিন্তু কানহাইয়া কুমার, অনির্বান ভট্টাচার্য, সৈয়দ উমর খলিদ-রা গেলে হয়। কারণ, এরা ‘হিন্দু মুখ। এরা ‘ভূমিহার’। এরা ‘সৈয়দ’। এরা হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মেরই উঁচুজাত।
এই বক্তব্য লিখিত আকারে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর উমর খলিদ এর উত্তর দেয় ‘খোলা চিঠি’ দিয়ে। তাতে উমর ১০ মে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে সামাজিক ন্যায়ের ইস্যুগুলো — যেমন — ভাইভা ভোসি ও ওবিসি সংরক্ষণের আলোচনা না হতে দেওয়ার অভিযোগের সরাসরি কোনো উত্তর দেয়নি। বিষয়টির কোনো উল্লেখ না করে উমর ‘সমালোচনা’টির দায় ‘সংসদীয় বাম-এর জাতপাতের প্রশ্নটি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী’র ঘাড়ে চাপায়, এবং এই ‘সমালোচনা’টির সাথে একমত বলে জানায়। উমর মুসলিম সমাজে নিজের উচ্চবর্ণীয় অবস্থানকে স্বীকার করে, মুসলিম সমাজের মধ্যে জাত ব্যবস্থার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। কিন্তু একইসাথে জানায় — যখন হিন্দুত্ববাদীরা এসে গুজরাত ও মুজফফরনগরে মুসলিমদের আক্রমণ করে হত্যা করে ধর্ষণ করে, তখন তারা জাতবিচার করে না। উমর বলে, আদিবাসী এবং দলিত যেমন এদেশে নিপীড়িত, মুসলিমও তাই। উমর আরো বলে, সে মিডিয়া হাইলাইট পেয়েছে জেএনইউ-এর ছাত্র হিসেবে জেল-এ গেছে বলে, উঁচুজাতের মুসলিম বলে নয়।
উমর মুসলিমের জাতবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, কিন্তু হিন্দুর জাতবিচারের পক্ষে দাঁড়ায়।
এর প্রত্যুত্তর রাহুল সোমপিম্পলে একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে দেয়। তাতে সে বলে, উমর যেভাবে মুসলিমদের মধ্যে জাতপাতের ভেদাভেদকে অস্বীকার করতে চেয়েছে, তার সঙ্গে আরএসএস যেভাবে হিন্দুদের মধ্যে জাতপাতের ভেদাভেদ-কে অস্বীকার করতে চায়, তার মিল রয়েছে। রাহুল প্রশ্ন করে, উমর-এর এই অবস্থানে ‘পিছড়া পিছড়া এক সমান, হিন্দু হো ইয়া মুসলমান’ — এই স্লোগানের জায়গা কোথায়? উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে সামাজিক ন্যায়পন্থীদের দীর্ঘদিনের অবস্থানগত স্লোগান এইটি। রাহুল আরো বলে, জেএনইউ-এর এই আন্দোলনে উমর-এর সঙ্গী জেএনইউ ছাত্র ইউনিয়ন ও কানহাইয়া কুমার তো কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করে, এবং সেটা তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছে। এই জন্য সে কি কখনো তাদের কোনো ‘খোলা চিঠি’ দিয়েছে? উমর-এর বর্তমান ছাত্র সংগঠন-এর নামের মধ্যে রয়েছে আম্বেদকর। এই বিষয়টিতেও শ্লেষ জানিয়ে রাহুল বলে, আম্বেদকরের নামে সংগঠন খুলেছে উমর, কিন্তু আম্বেদকর কাশ্মীর ও সেখানকার গণভোট নিয়ে কী বলেছিল, তা কি জানা আছে তার?
একইসাথে জেএনইউ শুনতে খুব প্রগতিশীল হলেও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে তার প্রগতিশীলতাকে প্রশ্ন করেছে সামাজিক ন্যায়পন্থী ছাত্রছাত্রীরা। জেএনইউ-এর ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে যেই আসুক, সে এসএফআই, এআইএসএফ, ডিএসএফ বা অধুনা আইসা, তারা ওবিসি সংরক্ষণ, ভাইভা ভোসির নম্বর কমানোর মতো বিষয়গুলোর প্রশ্নে ইচ্ছে করে নীরব দেখেছে বলে অভিযোগ বাপসা-র।
নিচের লিঙ্কে এই বিতর্কে বিভিন্ন বক্তব্যের পুরোটা ইংরেজিতে রয়েছে
http://songbadmanthan.com/wp-content/uploads/2016/05/Bapsa-Aisa-Umar-debate-on-JNU.pdf
Leave a Reply