২২ জানুয়ারি, সুশান্ত দাস, কলকাতা#
জাইতাপুরের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল ফেসবুকের মাধ্যমে। আমার এক বন্ধু আছে প্রদীপ ইন্দুলকার, যিনি জাইতাপুরের ওই অঞ্চলটাতে ঘোরাফেরা করেন। তিনি ডকুমেন্টারি ফিল করেন, বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে থাকেন। আমি ওঁকে জানাই যে আমি নাটকের মাধ্যমে কিছু কাজ করতে চাই। তখন তিনি কয়েকজনকে আমার কথা বলেন। আমার নাটক ওখানে গত বছর জুলাই মাসে হওয়ার কথা ছিল। তারপর নানা কারণে প্রোগ্রাম পিছিয়ে যায়, বাতিল হয়ে যায়। ব্যাপারটা ওখানেই থেমে যায়।
তারপর আবার ওখান থেকে একজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ফেসবুকে মেসেজ করে। এঁর নাম ফকির মহম্মদ। তিনি মৎস্যজীবীদের শাখারি নাটে গ্রামেই থাকেন। মৎস্যজীবীরা প্রায় সবাই মুসলমান সম্প্রদায়ের। জাইতাপুরের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কেন্দ্র ওটাই, ওখান থেকেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। যেখানে প্ল্যান্ট তৈরি করার কথা, সেটা উল্টোদিকে তিন কিলোমিটার দূরে। সামনে সমুদ্র, সেইজন্য কিছুটা ঘুরপথে একটা সেতু পেরিয়ে সাইটে যেতে হয়।
এবার যখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ভারতে এলেন এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভারত-জাপান পরমাণু চুক্তি করলেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হল জাইতাপুরের শাখারি নাটে গ্রামে। বহু জায়গায় প্রতিবাদ হয়েছে। মুম্বইয়ে দাদার স্টেশনের বাইরে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর। একই সময়ে কলকাতাতে হয়েছে, নাগপুরে হয়েছে, দিল্লির যন্তরমন্তরেও প্রতিবাদ হয়েছে।
ফকির মহম্মদ আমাকে এই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য খবর দিলেন। ৮ ডিসেম্বর সকালবেলায় আমি মুম্বইয়ে পৌঁছালাম। পরদিন আমি গেলাম রত্নাগিরি, সেখান থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে শাখারি নাটে গ্রাম। সেখানে পৌঁছে পরদিন আশপাশের গ্রামগুলোতে যাওয়া শুরু করলাম। আমার সঙ্গে ওখানকার আন্দোলনের সাথিরা ছিল। তারা গ্রামে গ্রামে প্রচার করছিল, সকলে যাতে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগদান করে। এই আন্দোলন পরিচালনা করছে জাইতাপুরের জনহক্কা সেবা সংগঠন।
পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হলে তার প্রভাব এই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে পড়বে। পৃথিবী বিখ্যাত আলফানসো আম এখানে প্রচুর ফলন হয়। তার ওপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পড়বে। আমের স্বাদ হয়তো থাকবে, দেখতেও একইরকম হবে, কিন্তু তার ভিতরে অদৃশ্যভাবে ক্যানসারের বীজ রয়ে যাবে! মৎস্যজীবী যারা রয়েছে, তাদের দিনে ৮০০-৯০০ টাকা রোজগার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু মানুষ ওই অঞ্চলে মৎস্যজীবী পেশায় যুক্ত রয়েছে। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সমুদ্রে অনেকে মাছ ধরতে যায়। তারপর সেই মাছ ডাঙায় এনে প্যাকিংয়ের কাজ হয়। সেগুলো কোথায় কোথায় যাবে সেইভাবে ভাগ করা হয়। সন্ধ্যাবেলা লরি আসে, প্যাকিং করা মাছ সেইসব লরিতে তুলে দেওয়া হয়। সেগুলো প্রথমে যায় রত্নাগিরিতে। সেখান থেকে মুম্বই সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় সেই মাছ চলে যায়। এমনকী বিদেশেও এক্সপোর্ট হয়। পরমাণু তেজস্ক্রিয়তার বিপদের আশঙ্কা করছে মৎস্যজীবীরা।
১২ ডিসেম্বর কর্মসূচি ছিল একটা জেল ভরো আন্দোলন। শাখারি নাটে গ্রামে এমন একটা কর্মসূচির জন্য আগে থাকতেই পুলিশ সহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়েছে। আমার নাটক ‘একটি মাছের কাহিনী’ ছিল তার আগের দিন ১১ তারিখ। খোলা মাঠ একটা আর আশেপাশে চারদিকে দর্শকেরা ভিড় করে ঘিরেছিল। গ্রামের একদম পাশেই ওই জায়গাটায় কবরস্থান করা হয়েছে ২০১১ সালে, যেটা আদতে কবরস্থান ছিল না। তখন একটি ছেলে মারা যায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে। তাকে ওই জায়গাটায় কবর দেওয়া হয়। আর একজন গুরুতরভাবে আহত হয় মাথায় গুলি লেগে। এতখানি ক্ষোভ ছিল মানুষের মধ্যে যে পুলিশ সে সময় গ্রামে ঢুকতে পারেনি। ২০১৪-র কোনো একটা সময় থেকে ওই গ্রামে ফের পুলিশ একটু একটু করে ঢুকতে আরম্ভ করে। নাটকটা হয়েছিল কবরস্থানের ঠিক পাশেই। পাহাড়ি এলাকা, ওপর দিকটায় কবরস্থান, আমাদের জমায়েতটা নিচের দিকে। ওখানে একটা মসজিদ রয়েছে। প্রথমে কথা হচ্ছিল যে মসজিদের ভিতরের চাতালেই নাটক হবে। পরে আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম যে মসজিদের বাইরের মাঠে হলে লোকের নাটক দেখতে সুবিধা হবে। মহিলারা জায়গাটা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। সবাই বেশ ভালো উপভোগ করেছে নাটকটা। নাটকে প্ল্যাকার্ডও ছিল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র লেখা। পরমাণু তেজস্ক্রিয়তার দূষণ, পরমাণু শক্তির পক্ষে সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের ওকালতি এবং তার বিরুদ্ধে জন-প্রতিরোধ, সবটাই একটা মাছের চোখ দিয়ে দেখানো হয়েছে নাটকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে।
কুডানকুলাম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন এক বড়ো জমায়েতে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইদিনথাকারাই গ্রামে প্রথম এই নাটক করা হয়েছিল।
পরদিন শিনজো আবের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির প্রতিবাদে খুবই বড়ো জমায়েত হয়েছিল শাখারি নাটে গ্রামে। প্রায় হাজার দুয়েক লোক জড়ো হয়েছিল সেখানে। তার মধ্যে এক হাজারের বেশি মহিলা ছিল, যারা আশপাশের গ্রাম থেকেও অনেকে এসেছিল।
জাইতাপুর থেকে গেলাম মুম্বইয়ে। টাটা ইনস্টিট্যুট অফ সোশাল সায়েন্সেস-এ ছাত্রদের উদ্যোগে নাটক হল। এ পর্যন্ত ৬৩টা শো হয়েছে এই নাটকের। গত বছর কেরালায় ছ-টা শো করেছি। এছাড়া দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, আমেদাবাদ, ইন্দোর, কর্নাটক, কলকাতায় শো হয়েছে। গত বছর লন্ডনেও একটা শো করতে গিয়েছিলাম।
Leave a Reply