[তিউনিশিয়া থেকে ম্যাথু গ্যালতিয়ের এর রিপোর্ট, ফ্রান্সের লিবারেশিওঁ পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত, ৩০ অক্টোবর। বৃহস্পতিবার সদ্য-অভিবাসী মুসলিম যুবক ব্রাহিম নিস শহরের একটি গির্জায় ছুরি চালিয়ে তিনজনকে খুন করে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘শার্লি এব্দো’ ব্যাঙ্গচিত্র পত্রিকায় কয়েক বছর আগে প্রকাশিত কার্টুন নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছে ফ্রান্স। সেই পুরনো ব্যঙ্গচিত্র স্কুলের ‘মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা’-র ক্লাসে দেখানোর কারণে ফ্রান্সের মুসলিম সমাজের একাংশের বিরাগভাজন হন শিক্ষক স্যামুয়েল পাতি। এক ছাত্রীর বাবা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং তার নাম ঠিকানা সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। কিন্তু ঘটনা শুধু এই গণতান্ত্রিক পরিসরে থেমে থাকেনি, নৃশংসভাবে খুন হন শিক্ষক স্যামুয়েল পাতি। অভিযুক্ত হন একজন কমবয়সী মুসলিম অভিবাসী, যিনি পরে পুলিশের গুলিতে মারা যান। সেই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে ফ্রান্স। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ফ্রান্সের প্রায় আশি শতাংশ মানুষ মনে করছেন, স্যামুয়েল পাতি-র খুন আসলে ইসলামিস্টদের ফ্রান্স রিপাব্লিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধান ম্যাক্রোঁ সরাসরি ইসলামিস্টদের দায়ী করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের ধর্মীয় উদার সমাজকে ভেঙে ফেলার উসকানির অভিযোগ আনেন। এর বিরুদ্ধে একাধিক মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের প্রধান বিবৃতি দেন। উল্লেখ্য, উত্তর আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত একাধিক রাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের খনি নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রান্স। ]
শমীক সরকার। কলকাতা। ১ নভেম্বর, ২০২০।#
উত্তর আফ্রিকার তিউনিশিয়ার রাজধানি তিউনিশ শহর থেকে আড়াইশো কিমি দূরের শহর স্ফ্যাক্স। স্ফ্যাক্স শহরের এক কোণের শহরতলী, যেখান থেকে ব্রাহিম চলে গেছিল দিন কয়েক আগে, সেখানে তার বন্ধুরা ব্রাহিমের একটা চেহারা খাড়া করল — বেআইনি জ্বালানি তেলের কারবারি, যে বছর দুয়েক হল ঝুঁকেছিল ধর্মের দিকে।
দরজা বন্ধ, কিন্তু ভেতর থেকে আওয়াজ শোনা গেল স্পষ্ট — “ও ভগবান”, “তোদের মরণ হয় না”। তার কিছুক্ষণ পরে, ব্রাহিমের এক বোন বেরিয়ে এল। ব্রাহিম, যে কি না ফ্রান্সের নিস শহরের গির্জায় বৃহস্পতিবার যে ছুরি হামলা হয়েছে (তিনজন মারা গেছে) তার প্রধান অভিযুক্ত। ব্রাহিমের বোন বাড়ির সক্কলকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের সাংবাদিকদের চলে যেতে বলল। কিন্তু, হঠাৎই, তার মা সামনে এল, কালো হিজাব একটা ফুলের নকশা করা মাথাবন্ধনী দিয়ে বাঁধা, পুরনো ব্লাউজ, চিৎকার করে বলল — “আমরা কোনো সালাফি নই। আমরা একটা ভালো পরিবার”।
ব্রাহিমের বাবার অনেকগুলো ছানাপোনা। ব্রাহিমের সাত কি আট জন বোন (সেরকমই বলল), দুটি ভাই। বাবা ও মা দুজনেই আলাদা আলাদা করে বলল, ব্রাহিম মাত্র দু-বছর হল মসজিদে যায়, সে মৌলবাদী হতেই পারে না : “রাত আটটা বাজলে সে ঠিক বাড়ি চলে আসবে রাতের খাবার খেতে। তারপর যাবে মসজিদে, ইশা-র নামাজ পড়তে (দিনের শেষ নামাজ)। তারপর একটু চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে ঘুমোতে আসবে। সে কখনও তার কোনো বন্ধুদের বাড়ি নিয়ে আসত না।” তার মা বিশদে জানালো। সারা দিন সে মোটরগাড়ির গ্যারেজে থাকে, যেখানে সে কাজ করে মেকানিক হিসেবে। মাসে ৩০০ দিনার (৯৩ ইউরো) পায়। আপাতদৃষ্টিতে নিয়মমাফিক জীবন, বেশ কয়েকবছর মদ গাঁজার চক্করে কাটিয়ে তারপর সে পাড়ার মসজিদে ঠাঁই নিয়েছে।
জ্বালানি তেলের কারবার
সে যে ইউরোপ পাড়ি দিচ্ছে, তার কোনো আভাস বাবা-মায়ের কাছে ছিল না। “প্রত্যেকদিন রাতে আমাদের ফোন করে জানাতো, সব ঠিকঠাক আছে। ইতালিতে (কোয়ারান্টাইন পর্ব শেষ হবার পর), সে অলিভ ক্ষেত-এ কাজ করত। বুধবার রাতে সে ফ্রান্সে গিয়ে পৌঁছেছিল। সেদিন বলল, বাইরে ঘুমিয়েছে। একটা গির্জার কাছে একটা বাক্সের মধ্যে। কিন্তু পরদিনই কিছু বন্ধুর সাথে তার দেখা হবার কথা আছে, যারা তাকে কাজ পাইয়ে দেবে বলেছে একটা।” — জানালো তার এক ভাগনা, আলি, যার ডান চোখটা নেই। সে কিছুতেই কল্পনা করতে পারছে না তার তুতো-ভাগনা একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি, যে কিনা শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে এতটাই সুস্থির।
সে স্বীকার করল যে ব্রাহিম গ্যারেজের মেকানিকের কাজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিল চোরাই জ্বালানি তেলের লোভনীয় কারবারে : যে কাজে আয় অনেক বেশি, এন্নাস্র-র এক ঘিঞ্জি গলির তরুনদের জন্য অনেক আকর্ষনীয়। স্ফ্যাক্সের শিল্পাঞ্চলের দক্ষিণে সীমান্তবর্তী এলাকা এন্নাস্র। তিউনিশ-এর ২৫০ কিমি দক্ষিণে। বন্দর শহরের প্রাচুর্য্য কুড়িয়ে বাড়িয়ে যে এলাকা দাঁড়িয়ে আছে। ব্যবসা মানে হল যেখানে গ্যারেজ, এন্নাস্র থেকে গাবে বন্দরে যাবার পথে ট্রাকগুলির জন্য। লিবিয়ার তেলের খনিতে কাজই হল যেখানে দারিদ্র্য-র চটজলদি দূরীকরণের একমাত্র উপায়।
দুটি ভেড়া ও কতগুলি মোরগ
ব্রাহিমের বাবা মোহামেদ, নিজেকে বললেন একজন অভিভাবক। পাড়া প্রতিবেশী জানালো, সে একজন বেকার লোক, যার দুটি ভেড়া আর কয়েকটি মোরগ সম্বল। যে বাড়িতে ওরা থাকে, সেটা এখনও পুরো তৈরি হয়নি। ওই পাড়ার আর সব বাড়ির মতোই। খালি ইঁটের তৈরি সিঁড়ি বাইরের দিকে, পরিবারের দারিদ্র্যের চিহ্ন বহন করে। কাইরুয়ান এলাকার বু হাজরা গ্রামে আদি বাড়ি। কুড়ি বছর আগে, ব্রাহিমের জন্মের ঠিক পরপরই, তার বাবা দেড়শো কিমি দক্ষিণে শিল্পনগরী স্ফ্যাক্সে চলে আসেন ছেলের উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
কিন্তু সে ছেলে ১১ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দিয়ে “সহজ রাস্তায় চলে যায়”। এএফপি-র রিপোর্টে আছে, তিউনিশিয়ার সরকারি নথি অনুযায়ী ব্রাহিম হিংসা ও ড্রাগের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল। একজন বন্ধু জানালো, সে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তারও হয়েছিল পাড়ায় একটা ঝামেলার জন্য। তখনও সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। তার পরিবারের বক্তব্য, দু-বছর সে কাজ খোঁজার চেষ্টা করেছিল। ইউরোপিয়ান অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়ার আগে সে লাগাতার ভালো কাজ খুঁজে গেছে।
কিছুদূর গিয়েই অন্য এক ব্রাহিমের খোঁজ পাওয়া গেল। পাড়ার একটি ছেলে জানালো, “ঈদের দিন আমরা একটু মদ আর গাঁজা খেয়েছিলাম”। গাবে-র রাস্তায় অন্য দিকে, মসজিদের মুখোমুখি, এন্নাস্র-র চায়ের দোকানে, যা ছিল ব্রাহিমের এক সময়ের ঠেক। “ব্রাহিম হল আমাদেরই মতো, তিউনিশিয়ার এক গরীব ছেলে। সে ইউরোপের স্বপ্ন দেখতো, যেমন আমরাও দেখি। সে ভালোবাসত মেয়ে আর গতি। এই তো মাস ছয়েক আগে, তাকে দেখেছিলাম একটা মোটরবাইকে একটা বেশ্যাকে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।” চায়ের দোকানে এক বন্ধুর কাছে জানা গেল। সে বলল, গত একবছর ধরে ব্রাহিমকে নিয়মিত দেখা যেত না এই চায়ের দোকানের ঠেক-এ।
ইউরোপ অভিবাসনের উপায়
হঠাৎ সে বছর দুয়েক আগে ধর্মের দিকে ঝুঁকল কেন? এই বন্ধুরাও বলল, সে নামাজ পড়তে যেত ইদানিং, অন্য সব কিছু করার সঙ্গে সঙ্গেই। এন্নাস্র-র কেউই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। কিন্তু ব্রাহিমের বাবা খুবই সোজাসাপটা উত্তর দিল, ছেলে যে আস্তে আস্তে জঙ্গী হয়ে উঠছিল তার কোনো ইঙ্গিত সেই উত্তরে নেই : “ম্যাক্রোঁ, শার্লি এব্দো, ব্যঙ্গচিত্র, সে এসবের কিছুই জানত না। সে ফরাসী বলতেও পারত না। সে বেশিদিন স্কুলেই যায়নি। কয় সপ্তাহ আগে সে চলে যাবার আগে তার মারাত্মক ধর্মীয় হয়ে ওঠারও কোনো ইঙ্গিত ছিল না। চলে যাবার পর টেলিফোনেও সে ধর্মের কথা বলত টলত না।”
তার বন্ধুরা আবার তার যাবার যে বর্ণনা দিল, তাতে অবশ্য তাকে এত সোজাসাপটা গোবেচারা বলে মনে হয় না। ব্রাহিমের ইতালি যাবার কারণ ছিল। তার যে বেআইনি কারবার, তাতে ভূমধ্যসাগরে নৌকা নিয়ে যাবার পারমিট জোগাড় করা ছিল। তার আত্মীয় স্বজনের মতে, সে এন্নাস্র এবং আশেপাশের আরো ষোলো জন অল্পবয়সীর সঙ্গে গেছিল। এতে বোঝা যায়, সে পরিকল্পিত ভাবে গিয়েছিল এমন নয়, কিন্তু সে ও তার বন্ধুরা যে ইউরোপ চলে গেছিল, তা তার এই কারবারের হাত ধরেই।
শেষমেশ, পাড়াতে একজনই একটা তথ্য দিতে পারল ব্রাহিম সম্পর্কে। সে হল ব্রাহিমের বাড়ির কাছাকাছি একমাত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিনি মার্কেট-এর মালিক হামজা জেলাসি। “ওর কাছে একটা বেনামা মোবাইল সংযোগ ছিল, কারণ ও এখানে নিয়মিত আসত তার রিচার্জ করার জন্য। শুধু এজন্যই আসত। চকোলেট খেতে, কফি খেতে বা অন্য কোনো কারণে কখনও আসত না।”
Leave a Reply