পরিমল আদক। কলকাতা। ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০।#
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনার লকডাউনের সুযোগ নিয়ে কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের মৃগয়াভূমিতে পরিণত করতে চেয়ে তিনটি অর্ডিন্যান্স আনে কেন্দ্রের বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন সরকার। সেই তিনটি বিলের নাম, অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংযোজনী ২০২০ বা The Essential Commodities (Amendment) Ordinance, 2020; দাম নিশ্চিন্তি ও কৃষি পরিষেবার চাষি (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তি অর্ডিন্যান্স ২০২০ বা The Farmers (Empowerment And Protection) Agreement On Price Assurance And Farm Services Ordinance, 2020; এবং চাষির ফসলের ব্যবসা ও বাণিজ্য (অগ্রগতি ও সুবিধা) অর্ডিন্যান্স ২০২০ বা The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Ordinance, 2020।
আমরা বলার সুবিধার্থে প্রথমটিকে ‘অত্যাবশ্যক পণ্য সংযোজনী আইন ২০২০’, দ্বিতীয়টিকে ‘চুক্তি-চাষ আইন ২০২০’ এবং তৃতীয়টিকে ‘ফসল বাণিজ্য আইন ২০২০’ বলে অভিহিত করব। এই তিনটি অর্ডিন্যান্সই লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন শুরু হতেই আইন হিসেবে পেশ হয়েছে। সবক’টিই লোকসভাতে পাশ-ও হয়ে গেছে (১৫ ও ১৭ সেপ্টেম্বর), যদিও রাজ্যসভায় পাশ হতে বাকি আছে। ফলতঃ এগুলিকে আইন হিসেবে অভিহিত করা যেতেই পারে।
সংক্ষেপে এই আইনগুলিতে কী কী আছে দেখে নেওয়া যাক।
অত্যাবশ্যক পণ্য সংযোজনী আইন ২০২০
১) এই আইনটি ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংযোজনী। আইনটিতে কিছু পণ্যকে (খাদ্য পণ্য, সার, পেট্রোলিয়াম পণ্য) অত্যাবশ্যক আখ্যা দিয়ে সেগুলির উৎপাদন, সরবরাহ তথা ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু নিয়ন্ত্রণ কায়েম ছিল।
২) সংযোজনীতে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার কেবলমাত্র অস্বাভাবিক অবস্থাতেই কিছু শস্য, আলু, পেঁয়াজ, তেল এর ওপর এই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, বাকি সময় পারবে না। এই অস্বাভাবিক অবস্থা হল — যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বিশালাকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
৩) আইনে ছিল, এই অত্যাবশ্যক পণ্যগুলির মজুতের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সংযোজনীতে বলা হচ্ছে, কেবলমাত্র অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হলে তবেই মজুতের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কেন্দ্রীয় সরকার। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বলতে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বা গত পাঁচ বছরের গড় বাজার মূল্যের তুলনায় ক) পচে যায় এমন কৃষিজ খাদ্যদ্রব্যের ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি খ) বনজ দ্রব্যের ১০০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি।
৪) সংযোজনীতে বলা হচ্ছে, উপরিউক্ত পণ্যগুলির মজুত-সীমা কৃষিজ দ্রব্যের প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত যারা (এবং সে তার গুদামের সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে যদি মজুত করে) বা রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত যারা, তাদের ক্ষেত্রে খাটবে না।
চুক্তি-চাষ আইন ২০২০
১) এই আইনটি চাষি (পশু/পাখি চাষি সহ) এবং একজন ক্রেতা (ব্যক্তি, কোম্পানি, সংস্থা) র মধ্যে চুক্তি-চাষ এর নিয়ম ঠিক করছে, যে ফসল বোনার পূর্বেই চাষির সঙ্গে সর্বনিম্ন এক মরশুম ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য তার ফসল কিনে নেবার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। যদি মরশুম পাঁচ বছরের বেশী হয়, তাহলেও সর্বোচ্চ এক মরশুম।
২) চুক্তিতে ফসলের দাম এবং তার নানাপ্রকার ভেদাভেদ, যেমন, গ্যারান্টি মূল্য, ইনসেনটিভ পরিষ্কারভাবে লেখা থাকতে হবে। কীভাবে এই দাম নির্ধারণ হল, তাও থাকতে হবে চুক্তিতে।
৩) চুক্তিতে ফসলের গুণমান কেমন হবে এবং কীভাবে চাষ করা হবে (সার, জল, কৃষিশ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি) তাও নির্দিষ্ট করা থাকতে হবে। এই গুণমান পালন করা হচ্ছে কি না চাষের সময় বা ডেলিভারি নেবার সময়, তা কোনো সংস্থাকে দিয়ে বিচার করানো যাবে।
৪) গুণমান বিচার করে ঠিক সময়ে ফসল গ্রহণ করে দাম চুকানোর দায়িত্ব ক্রেতার। বীজের চুক্তি থাকলে তার দামের অন্ততঃ এক তৃতীয়াংশ চাষিকে একমাস বাদেও মেটাতে পারে ক্রেতা।
৫) চুক্তিতে চাষির জমি বিক্রি, লিজ, বন্ধক সংক্রান্ত কোনো কিছু থাকা চলবে না। চাষির জমিতে ক্রেতা কোনো স্থায়ী কাঠামো বানাতে পারে চুক্তির সময়সীমার জন্য, বা জমির দশারও পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে চুক্তির শেষে জমিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে চাষিকে।
৬) চুক্তি চাষে ভাগচাষির অধিকার রক্ষা করতে হবে।
৭) কোনো কৃষক সংস্থা বা কৃষি পরিষেবা সংস্থা এই চুক্তির মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ঢুকতে পারে।
৮) উপযুক্ত কারণে চাষি ও ক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে এই চুক্তি মাঝপথে বদলে যেতে পারে বা শেষ হয়ে যেতে পারে।
৯) রাজ্য সরকার এই আইনে চুক্তিবদ্ধ ফসলের ওপর নিজের কোনো আইন লাগু করতে পারবে না। শুধু এই চুক্তি রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে পারে এবং এই আইন লাগু করার জন্য রুল তৈরি করতে পারে।
১০) এই চুক্তির মধ্যে কোনো মতবিরোধ প্রশাসনিক স্তরে সমাধা করতে হবে সর্বোচ্চ দু-মাসের মধ্যে। এই চুক্তির ভিত্তিতে বীমা করা যাবে।
ফসল বাণিজ্য আইন ২০২০
১) এতদিন চাষির (পশু/পাখি চাষি সহ) ফসল বিক্রি হতে পারত বিভিন্ন রাজ্য সরকারের APMC আইন বা কৃষিপণ্য বাজার আইনের দ্বারা স্বীকৃতি ও নিয়ন্ত্রিত বাজারে। এই বাজারে চাষির ফসলের ক্রেতা হবার জন্য লাইসেন্স লাগত। কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইনের ফলে এই বাজারগুলির বাইরেও কৃষক তার ফসল বিক্রি করতে পারবে।
২) প্যান কার্ড থাকলেই যে কেউ (ব্যক্তি, কোম্পানি, সংস্থা) কৃষকের পণ্য সরাসরি কিনতে পারবে ও তার ইলেকট্রনিক ট্রেডিং করতে পারবে, রাজ্যের ভেতরে বা ভিন রাজ্যে। এর বিকিকিনির জন্য কোনো ফি, লাইসেন্স, কমিশন ইত্যাদি লাগবে না বা রাজ্য সরকার সেরকম কিছু ধার্য করতে পারবে না। কৃষক সংগঠন বা তাদের সমবায় সংস্থা বাদে প্যান কার্ড ছাড়া কেউ ফসল বাণিজ্য করলে তার জরিমানা হবে ২৫ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
৩) এই বিক্রিবাটা চাষির জমিতে, গুদামে, কারখানার গেটে, হিমঘরে ইত্যাদি যে কোনো জায়গায় হতে পারে, শুধু রাজ্য সরকারের পূর্ব নির্ধারিত বাজার এলাকা বাদে।
৪) চাষির কাছ থেকে ফসল কিনে ইলেকট্রনিক বা অন্য উপায়ে ট্রেডিং করা ক্রেতা/বিক্রেতা চাষিকে ফসলের দাম তিনদিন পরে অবদি মেটাতে পারে।
৫) যে কোনো কোম্পানি বা সংস্থা ইলেকট্রনিক ট্রেডিং সংস্থা খুলতে পারে। তার নিয়মকানুনও তৈরি করতে পারে। তবে এর নিয়মকানুন কেন্দ্রীয় সরকারও তৈরি করে দিতে পারে।
৬) এই ফসল বাণিজ্যে কোনো মতবিরোধ দুই মাসের মধ্যে প্রশাসনিক স্তরে মেটানো হবে।
বিভিন্ন রাজ্য সরকার নির্ধারিত বাজারে চাষির ফসল বিক্রি -তে ফড়েদের দাপট ও তাদের দাম নিয়ন্ত্রণ করার কারণে চাষিদের ফসলের দাম কম পাওয়ার সমস্যা সর্বজনবিদিত। যেহেতু লাইসেন্সের মাধ্যমেই কেবল এইসব বাজারগুলিতে ব্যবসায়ী হওয়া যায়, এবং সেই লাইসেন্স সীমিত, তাই কৃষিপণ্যের মূল্য এরাই নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই সমস্যা মেটানোর বদলে কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া ফসল বাণিজ্য আইন ফসলের বাজারকে সরাসরি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে বলে পাঞ্জাব হরিয়ানা সহ দেশের নানা প্রান্তের চাষিদের অভিযোগ। এর ফলে চাষি আরো অসহায় হবে বলেই তাদের ধারণা। এছাড়া চুক্তি চাষের মাধ্যমেও চাষি ফসল উৎপাদনের ওপর নিজের কর্তৃত্ব হারাবে এবং গুণমানের যাঁতাকলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াবে বলে প্রতিবাদী চাষিদের আশঙ্কা। এছাড়া এই তিন আইনের বলে কেন্দ্রীয় সরকার ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দিতে চাইছে বলেও চাষিদের আশঙ্কা। যে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য ফসলের দামের একটা মান ঠিক করে দেয় এবং বাজার মূল্য তার আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে যদি সরকার চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ফসল কেনে বেশি বেশি। পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিরা এই তিনটি আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করছে রাস্তায় নেমে। আগামী ২৪-২৫-২৬ সেপ্টেম্বর তারা ‘রেল রোকো’র ডাক দিয়েছে।
Leave a Reply