সুফল বাংলার কাউন্টার থেকে একজন আলু ক্রেতার অভিজ্ঞতা
স্মৃতিকণা দাস। শান্তিপুর। ১০ নভেম্বর, ২০২০।#
গরীবের আলুসেদ্ধ ভাত খাওয়ার দিনও বোধ হয় আজ ফুরিয়েছে। আলু ৪৫ টাকা কেজি হওয়ার পর থেকেই আলুর বিকল্প হিসেবে কচু, মান, অন্যান্য সবজির সন্ধান মিলছে। কিন্তু সেও তো আকাশ ছোঁয়া দাম। আলু একটা নিত্য প্রয়োজনীয় সবজি। তার কি বিকল্প সম্ভব?
এমতাবস্থায় কদিন আগে থেকেই শুনতে পাচ্ছি শান্তিপুরের বিভিন্ন পাড়ায় সরকার থেকে, কেউ বলছে পৌরসভা থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে আলু দিচ্ছে। পরিবার পিছু পাঁচ কেজি করে। কিন্তু সঠিক জায়গাটা কোথায় জানতে পারছিলাম না।
তিনদিন আগে ছেলের মুখে শুনলাম ডাকঘর মোড়ে আলু দিচ্ছে ২৫ টাকা কেজি দরে, ৫ কেজি পাবে। পাঠচক্র ক্লাবের সামনে। ব্যাপারটা কী জানতে সকাল ১১ টা নাগাদ গিয়ে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। আশেপাশের কয়েকজনকে জিগ্যেস করলাম, এখানে আলু কোথায় দেওয়া হয়? সবাই আকাশ থেকে পড়ল। উল্টোদিকের মিস্টির দোকানে শুধিয়েও নিরাশ হলাম। পরে চায়ের দোকানদার ছেলেটি জানাল, এখানে আলু দেওয়া হয়, কিন্তু এখন দেওয়া হবে না, কারণ যে ছেলেটি দেয় তার অশৌচ চলছে। আবার কালীপুজোর পর দেওয়া হবে। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলাম।
আবার ছেলের ফোনে জানলাম সন্ধে ৬ টা নাগাদ দেবে। ভাবলাম সত্যিই যদি দেয়, যাই কষ্ট করে। গিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই। পাঠচক্র ক্লাবের পাশেই দোকান খুলে বসা একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করায় জানলাম, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এখানে আলু দেওয়া হবে। অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সরব হতে দেখলাম সামনের সেই মিস্টির দোকানদারকে। ব্যাগ নিয়ে লাইন দিয়ে ফেলল। একে একে জমল লাইনে প্রায় দু’শ জন।
‘আলু নিতে গিয়ে তো পটল তুলে ফেলবেন। লাইনটা রাস্তা থেকে নামান।’ লাইন প্রায় পৌঁছল শনিমন্দির অবধি। শুরু হল টোকেন দেওয়া। লাইন খানিকটা এগোনোর পর শুনলাম টোকেন ৫০ টা দেওয়া হবে। কারণ আলু কম। পরিমাণ ৫ কেজির বদলে ৩ কেজি। বিস্তর ঠেলাঠেলি। কে হবে ওই ৫০ জনের মধ্যে একজন। আমার অবশ্য একটু সুবিধে হয়েছিল কারণ আমি ওইদিন দু’বার গেছি আলুর খোঁজে। তার ওপর সন্ধেবেলায় সবার প্রথম। এক ভদ্রমহিলাকে বলতে শুনলাম, আমি তো চন্দ্রমুখী খাই; দেখলাম যখন ২৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, যাই নিয়ে ৩ কেজি। পরের ভদ্রলোকটি বলে উঠল, তা আপনি যখন চন্দ্রমুখীর দলে, তবে কেন এই বিধুমুখীর খোঁজ? টোকেনটা দিন, আমি বরং নিই। আমরা এতজন লাইন দিয়ে আছি সেই বিকেল থেকে। আর ৫০ জনকে দিলেন! মজা হচ্ছে সরকারের আলু নিয়ে? – বিস্তর ঝগড়া চলল বেশ খানিকক্ষণ।
তাদেরকে থামাতে সংস্থার একটি ছেলে বলল, আপনারা অশান্তি করলে আলু দেওয়াই বন্ধ রাখব। এর আগে যখন ২০/৩০ বস্তা আলু এনেছিলাম তখন খরিদ্দার পাচ্ছিলাম না। আর এখন আলু কম, খরিদ্দার বেশি। আমাদের অবস্থাটা বুঝুন।
এত কিছুর পরেও আলুর খোঁজ তখনও মেলেনি। মিলেছে টোকেন। আর বেশ কিছু মানুষ যারা টোকেন না পেলেও হয়তো আলু পাব- সেই আশায়। ইতিমধ্যে টাঙানো হল ব্যানার ‘সুফল বাংলা’। জানতে পারলাম সরকারি ভাবে কেনা আলু শান্তিপুরের ‘শিল্পকলা সমবায় সমিতি’ সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে নিয়ে এসে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করছে।
শুরু হল ক্যামেরার খিচিক খিচিক। কেউ বিরক্ত হল মুখটা দেখাতে। কারণ কমদামি ক্রেতা হিসেবে পরিগণিত হতে চায় না। কেউ বলল, লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, আলু পাব কিনা ঠিক নেই। ফটো উঠে গেল!
তবুও আলুর দেখা মিলছে না। কারণ হিসাবে শুনলাম, রাস্তায় জ্যাম। উঁকিঝুঁকি চলতে চলতেই এলো আলুর টোটো। নামল তিনবস্তা। যাক বাবা তবে পাব আলু।
আবার লাইন। এবারে কে আগে নেবে এবং বড় সাইজের আলু নিতে হবে- তার রেষারেষি। সংস্থার কর্ণধার শমিত বোঝালেন, এই আলুটা কোথা থেকে আসছে। কেন আমরা এক জায়গায় বসছি না। কেন পাঁচ কেজির বদলে তিন কেজি। ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার ক্যামেরার খিচিক খিচিক।
কিন্তু সেকথা আর শোনা হল কই। মানুষ তখন জানতে উৎসুক কাল কখন কোথায় টোকেন পাবো। কিছু মানুষের আবার দাঁড়িপাল্লা ঠিক আছে কিনা- তাই নিয়ে সন্দেহ। সহাস্যে সে সন্দেহও দূর করলেন শমিত ওরফে বাবলি। একজন মহিলা তো আবার আমাকে ঠেলে বড় আলু বাছতে আগ্রহী। সবার আপত্তিতে তিনি তার গলা সপ্তমে চড়ালেন। তাকে থামাতেই দেখি আর একজন আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণটা বুঝলাম পরে। নতুন বস্তা খুললে তবেই ভদ্রলোক ওপর দিককার আলু নেবেন।
এবার লাইনে আমি। যাক বাবা ঝোলায় ৩ কেজি আলু মিলেছে। ঘড়িতেও সাড়ে আটটা। বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। রাস্তায় আসতে আসতে ভাবছিলাম, আলুর সাত কাহনটা পৌঁছে দেব সংবাদমন্থনের দ্বারা কিছু আলু-রসিকের কাছে। তার আগে অবশ্যই খেয়ে নেব শুকনো লঙ্কায় লাল করা আলু ভর্তা আর ভাত।
মাসে মাসে চাল আলু বিলি করতে যাওয়া এক বেতনভুক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা
পর্ণব। শালিগ্রাম। ১০ নভেম্বর, ২০২০।#
পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের নদিয়া জেলা দপ্তরের অর্ডার অনুযায়ী স্কুলে স্কুলে বাচ্চাদের জন্য চাল, আলু, ছোলা, সাবান আর ‘জয় বাংলা’ লেখা মাস্ক বিলি করা চলছে এ সপ্তাহে। এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং দপ্তরের নির্দেশ অনুযায়ী কেজি প্রতি আলুর ক্রয়মূল্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে আটত্রিশ টাকা। অর্থাৎ চলতি বাজারমূল্যের চেয়ে দু’পাঁচ টাকা কম। ফলে ঘাটতি মেটাতে শিক্ষকরা প্রতি প্যাকেটে নির্ধারিত পরিমাণ দু’কিলোর চেয়ে কিছু কম কিম্বা অন্য খাতের টাকা থেকে বা ধার করে বিলিব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন, জেলার প্রায় সর্বত্রই। এবছর আলুবীজের দামও চড়া। প্রায় দ্বিগুণ। এমনিতেই নদিয়ার ছোট চাষীরা খরচ বেশি বলে আলু চাষ না করে সর্ষে বা শীতের সবজি লাগান। একদিকে সুফল বাংলায় সরকারি রেট ২৫ টাকা প্রতি কিলো, আর স্কুলদপ্তরে সরকারি রেট ৩৮ টাকা প্রতিকিলো। উল্লেখ্য, ‘সুফল বাংলা’ প্রকল্পটি ২০১৪ সালে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে শুরু হয়েছিল। পশ্চিমবাংলা এগ্রি মার্কেটিং কর্পোরেশান লিমিটেডকে এই প্রকল্পের নো্ডাল এজেন্সি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে এক শিক্ষক প্রশ্ন তোলেন, বর্তমান বাজারে আলুর দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের মুনাফা লোটার ফাটকাবাজি কি সরকার তবে ঘুরিয়ে অনুমোদনই দিচ্ছে?
Leave a Reply