মাধবী মাইতি, ৮ নভেম্বর, মেদিনীপুর#
আমি ১৬ অক্টোবর বিকেলে বনবাড়িতে পৌঁছাই। ১৭ তারিখ থেকে শুরু হল বন উৎসব — বনকে কেন্দ্র করে বনকে চেনা, বনকে জানা, বনের মধ্যে থেকে গাছ জল মাটি আকাশকে দেখা। ২২ তারিখ দশেরা উদ্যাপন করে শেষ হল উৎসব। বনবাড়ির সর্বক্ষণের সদস্য বুয়া, ওঁর ছেলে দৌলত, স্ত্রী আম্বিবাঈ এবং ভরত সমেত আরও দু-চারজন আগে থেকেই ওখানে ছিল। চারধার খোলা মাটির ঘর, মাথার ওপর পাতার ছাউনি, এই হল আমাদের আস্তানা। পরদিন থেকে যারা এসেছে, অনেকেই তাঁবু খাটিয়ে এদিকে ওদিকে থেকেছে। অনেকে খোলা আকাশের নিচেও শুয়েছে। আমি অবশ্য মশারি নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি হাটখোলা ঘরের মধ্যেই শুয়েছিলাম। তার সামনে একটা গোল মতো উঁচু জায়গা আছে, তারই একপাশে হয়েছিল রান্নার ব্যবস্থা। ওখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, পাইপের জলও নেই। স্রোতধারা বয়ে গেছে পুরো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। একপাশে স্রোতধারার পাশেই রয়েছে জলের ইঁদারা। ওই জলই পানীয় জল।
১৭ তারিখে প্রথম ভাগে ছিল সবিতা উদয়ের কাজ। সবিতা উদয় বাঙ্গালোরের কন্নড় মেয়ে, স্কুলে পড়াত, ছেড়ে দেয়। ওর বাবা-মা কন্নড় স্বদেশি বা লোক জ্ঞান সংগ্রহ করেছেন। স্থানীয় খেলাধূলা যেগুলো হারিয়ে গেছে, যেমন আমাদের ছোটোবেলায় এক্কাদোক্কা খেলা ছিল, সবিতা সেগুলো জেনেছে। এইসব খেলায় শরীরটা সচল থাকে, মাথাটাকেও খেলাতে হয়। শতশত খেলা সবিতা সংগ্রহ করেছে। কিছু খেলা ও আমাদের দেখাল। আমরা বাচ্চা-বুড়ো সকলেই খেললাম। ওইদিন আরেকজন এসেছিলেন, উড়িষ্যার সুদর্শন। তিনি এক অসাধারণ দক্ষ চাষি। মাটি জিভ দিয়ে চেখে কিংবা নাক দিয়ে শুঁকে তিনি বলে দিতে পারেন যে জমির কী গুণ, কী চাষ হবে, কী হবে না, সব কিছু। পরেরদিন হল স্থানীয় জঙ্গলের খাদ্য নিয়ে একটা প্রদর্শনী। বনবাড়ির মধ্যে ভোরবেলা গাঁইতি কোদাল সব নিয়ে আমরা গেলাম জঙ্গলে। সুদর্শন উড়িষ্যা থেকে প্রচুর কন্দ ইত্যাদি নিয়ে এসেছিলেন। এমন অনেক কন্দ আছে, কিছু আমি চিনি। কিছু এমন আছে, আদিবাসীরা যখন গভীর জঙ্গলে চলে যায়, জল তেষ্টা পেলে কিংবা খিদে পেলে সেগুলো খানিকটা খেয়ে নিলে তেষ্টা বা খিদে মিটে যায়। এমন অনেক কন্দ আছে, যা প্রসূতি মেয়েদের জন্য ভালো। আমরাও গাছ থেকে, মাটির ভিতর থেকে অনেক রকম কন্দ জড়ো করলাম। জঙ্গলে দেখলাম, খামালুর ফল হয়ে যাছে। ওলের ডাঁটাও আমরা কেটে নিলাম। এগুলো খেলে গলা কুটকুট করে বটে। তবে রান্নার একটা নিয়ম আছে, সেটা জানতে হয়। সবিতা বলল, গনেশ চতুর্থীর পর এই ডাঁটা আর খেতে নেই।
সবিতার ছেলে আথনিয়া অ-প্রথাগতভাবে স্বরাজ ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে, তারপর পণ্ডিচেরি ইউনিভার্সিটিতে ইকোলজি নিয়ে পড়ছে। ও হিন্দিতে লেখা প্রচুর গান নিয়ে এসেছিল। তার মধ্যে রয়েছে লোকসংগীত আর রবীন্দ্রসংগীত। ও আমার কাছে এসে বসে গানের সুরগুলো শুনতে চাইছিল। আমি তো গান শুনি, করি না। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু করলাম। ভরত মানসাটা বাঁশি বাজাল। কমবয়সি আরও অনেকে গান গাইল। রাত অবধি গানের অনুষ্ঠান চলত।
সাতদিন ছিলাম ওই উৎসবে। আমার স্মৃতিতে একটার মধ্যে আরেকটা সব মিশে রয়েছে। কেরালা থেকে এসেছিলেন জেকব। তিনি এসআরআই বা শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ করেছেন। তিনি হাতে কলমে ধান চাষ শেখালেন আমাদের। বুয়ার ছেলে দৌলত ছ-সাত দিনের ধানের চারা তৈরি করে রেখেছিল। কীভাবে মাটি তৈরি করতে হবে, কীভাবে গাছ লাগাতে হবে সারিবদ্ধ ভাবে সব তিনি দেখালেন। জলাশয়ের ওপারটায় ধান লাগানো হল। আমি জেকবের কথায় খুবই সমৃদ্ধ হলাম। বুঝলাম যে ধান চাষ নিয়ে কর্পোরেট প্রচার কীভাবে আমাদের মাথাটা খেয়ে রেখেছে। আমার বয়স যখন কুড়ি-বাইশ, তখন জৈব চাষই আমার বাড়িতে এবং গ্রামে হত। পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানায় আমাদের গ্রাম। জেকবের পদ্ধতিতে একরে কুড়ি থেকে পঁচিশ কুইন্টাল ধান হয়। জলও বেশি লাগে না। চাষের জন্য কিছু যন্ত্রপাতিও জেকব তৈরি করেছেন।
সুইজারল্যান্ড নিবাসী আইনজীবী রোনাল্ড বনবাড়িতে এসেছিলেন পুনে থেকে একশো কিলোমিটার দূরের আহমেদনগর গ্রাম থেকে। ওখানে তিনি বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। আশপাশের গ্রামে সেখান থেকে জল বিক্রি করা হয়। এক-একটা পরিবার এই জল বিক্রি করে স্বনির্ভর হয়েছে। রোনাল্ডের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন ওই গ্রামের গীর্জার একজন পুরোহিত। আর এসেছিলেন নরসন্না কাপ্পালু। তিনি পার্মাকালচার নিয়ে বললেন। এগ্রিকালচারের মধ্যে যে কালচার রয়েছে, সেটা আমি নরসন্নার কথা শুনে বুঝতে পারলাম। কথা হচ্ছিল ইংরেজি আর হিন্দিতে। বুয়ার অসুবিধার জন্য একজন ওর পাশে বসে কথাগুলো মারাঠিতে অনুবাদ করে দিচ্ছিল। কখনও কখনও ভরতও এই কাজটা করছিল। প্রাকৃতিক উপায়ে সুস্থ থাকা এবং রোগ নিরাময় নিয়েও কেউ কেউ বলেছেন। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া, ধ্যান করা, যোগ ইত্যাদি দেখানো হয়েছে।
এতজন মানুষের জন্য রান্না হচ্ছে ইঁদারা থেকে জল এনে। রাতে মোমবাতির আলোয় রান্না হচ্ছিল। বেশিরভাগ ছেলেরাই রান্না করেছে। ইঁদারাতে বাচ্চা হাত ডুবিয়ে দিচ্ছে, পা ডুবিয়ে দিচ্ছে। জলে ছোটো ছোটো মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। আমার ওখানে যাওয়ার আগে খাবার, জল, এইসব নিয়ে খুঁতখুঁতানি ছিল। ওখানে গিয়ে সব কেটে গিয়েছিল। প্রকৃতির মধ্যে বাস করে আমাদের কিন্তু কোনো অসুখ-বিসুখ হয়নি। ওলের ডাঁটার তরকারিও সবাই চেটেপুটে খাচ্ছিল।
জঙ্গলের টিলাগুলোর মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতধারা, কোথাও সরু, কোথাও চওড়া। মাঝে একটা রকপুল, যেখানে পাথর দিয়ে বাঁধ মতো করে দেওয়া হয়েছে। জলটা পাথরের ভিতর দিয়ে কিছুটা শোধন হয়ে বয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার একটা পাথর দেওয়া বাঁধ, সেখানে জল শোধন হচ্ছে, আবার একটা বাঁধ, সেখানেও জল শোধন হচ্ছে। তারপর একটা শুকনো পাতা দিয়ে তিনদিকে ঘেরা জায়গা, সেখানে পাথরের ওপর বসে ঘটি দিয়ে জল তুলে স্নানের ব্যবস্থা।
৫৩ একর জায়গা জুড়ে বনবাড়ি। ভরত আর ওঁর বন্ধুরা মিলে এই জমিটা কিনেছিল কয়েক দশক আগে। মুম্বই থেকে পুনের মাঝে নেরাল নামে একটা স্টেশন আছে। সেখানে নেমে অটোতে ১০ কিলোমিটার গেলে বনবাড়ি। উৎসব চলাকালীন অনেকে এসেছে, মাঝে চলে গেছে, আবার নতুন কিছু মানুষ এসেছে। ২৫-৩০ থেকে ৭০ জন পর্যন্ত প্রতিদিন অংশ নিয়েছে উৎসবে। অনেকে বাচ্চাদের নিয়ে এসেছিল।
Leave a Reply