সিরাজুল ইসলাম। বত্রিশবিঘা, জামালপুর ব্লক, বর্ধমান। ১০ অক্টোবর, ২০২০।#
(…প্রথম কিস্তির পর)
কৃষক সংগঠন বলে কিছু নেই ; সরকারের ভূমিকা মোটেই স্বচ্ছ নয়
আমাদের আশপাশে যা দেখছি, ওয়েস্ট বেঙ্গলে এখন কৃষকদের কোনো সংগঠন নাই। বামফ্রন্টের আমলে কোনো জিনিসের দাম বাড়লে বলত, চলো মিছিল করতে হবে আজকে। পনেরো-বিশ বছর দেখছি, কই সেরকম তো কিছু নাই। এখন রাজনীতি নিয়েই রাজনৈতিক দলরা ব্যস্ত, অন্য কোনো দিকে নজর আছে?
দামোদর নদীতে আগে ফ্লাড হয়ে যেত। এখন তো মাটির নিচ থেকে যে বালি তোলে, ওটা ব্যান করে দিয়েছে সরকার। এখন যত কাজ সব নদীর বালি। ওই করতে করতে নদী এখন অনেক গভীর হয়ে গেছে। সেহেতু বন্যা হয়ে জলটা আর ওপরে ওঠে না। সব নদীর মধ্যেই চলে যায়। দুর্গাপুর থেকে শাখা হয়ে ক্যানাল আসছে। পাল্লা রোড থেকে অনেকগুলো শাখা বেরিয়েছে। মেমারির দিকে গেছে, আমাদের জামালপুরের দিকে এসেছে। রায়না বা খণ্ডকোষ কিংবা আমাদের জামালপুর ব্লকে ক্যানাল আছে, ক্যানালে জল দিয়ে দিল। যে যার চাষ করে নিল। এখন আর ক্যানালের ভরসাতেও নাই। এখন সরকারের ব্যাপারটা এমন একটা অবস্থা্নে রয়েছে, এই ক্যানালগুলো —- যখন দেখা গেল ধান রোয়ার সময় হয়ে গেছে, তখনও ক্যানাল পরিষ্কার হয়নি। আমার মাঠটায় দশটা মিনি বসবে, জল তুলে চাষ হবে, ওইগুলোতে প্রথম কথা প্রাকৃতিক ক্ষতি হচ্ছে। দ্বিতীয় কথা সেইটা যখন জল দিল তখন অলরেডি আমাদের ধানের চারা ধরে গেছে। ক্যানালের জলটা যখন দিয়ে দিল, তখন খানিক ডুবে চলে গেল। সরকারের ভূমিকাটা কৃষির ওপরে মোটেই স্বচ্ছ নয়।
এই গতবারে যখন জমিতে মানুষের আলু পাতা হয়ে গেছে, তখন কিছু আলুর বীজ দিল। সেই বীজগুলো কীরকম? কারো হয়তো এক বস্তা ভালো এসেছে, বাকিগুলো যা দিয়েছে তার পুরোটাই লস হচ্ছে। তারপর ধানের বীজ, যখন মানুষের বীজতলায় বীজ ফেলা হয়ে গেছে, তখন বলা হল, অমুক দিন ধানের বীজ দেওয়া হবে, তোমরা সব ব্লকে যাও। এক একজনকে দশ-পাঁচ-বিশ কেজি করে বীজ দিল, তখন বীজ ফেলা হয়ে গেছে, গাছ হয়ে গেছে। ওটা কোনো কাজেই লাগল না।
—সৌজন্যে তাম্রলিপ্ত অর্গানিক ফার্ম।
লেবার, তাদের মজুরি আর কাজের হালচাল
লেবারদের যে ব্যাপারটা … ধরুন কেউ এক বিঘে দশ কাঠা জমিতে চাষ করেছে, সে হয়তো একদিন বা দুদিন লেবার দিল, বাকিটা তো তাকে পরের জায়গাতেই লেবার দিতে হয়। তখন এই লেবারদের হয় কী?
আমার যখন আঠেরো-কুড়ি বছর বয়স, তখন আমি কিছু লেবারের কাজ করেছি। আমি সব কিছুই করেছি। এখন আর করি না। গত দশ-পনেরো বছর ছেড়ে দিয়েছি। ছেড়ে দিয়েছি বলতে মাঠে লেবার যেটা দিতাম সেটা দিতে পারি না, বয়স হয়েছে তো। এখন ছোটো ছেলেটা লোকজন দিয়ে করে। খুব বেশি জমি নাই আমার। ধরুন, আমাদের মাঠে আবাদ লেগে গেল। এই আমন ধান যেটা হয়েছে। তখন আমাদের ওখানে মিনি হয়ে গেছে। একজন মিনি চালিয়ে তার জমিটা রুয়ে নিল। তার পাশেই আমারটা, পাঁচশো টাকা লাগে, দিয়ে দে। গ্রামে এখন লাঙল গরু কিচ্ছু নাই। এখন সব ট্রাক্টর। সবাই যদি করে নেয়, গাড়ি ঢুকবে না আমার জমিতে। তাতে আমার পয়সা বেশি খরচ হলেও আমায় করে নিতেই হচ্ছে। আপনি যদি ভাবেন পরে করব, থাক, ক্যানালের জলটা এলে করব, এখন তো লাঙল নাই যে লাঙলটা নিয়ে গিয়ে করে নেব। এখন সব ট্রাক্টর।
আদিবাসী লেবার ছিল — এখন ফ্যামিলি প্ল্যানিং হয়ে গেছে, আদিবাসীদেরও একটা কি দুটোর বেশি বাচ্চা নাই। তাদের ছেলেরা এখন বড়ো হয়েছে, তারা আর লেবার দিতে চায় না। সোনার কাজে চলে যাচ্ছে, আমাদের এখানে সব কেরল-টেরল কাজে চলে যায়। জমির কাজ হয়তো কিছু করে, রাজমিস্ত্রি বা জোগাড়ের কাজে ওখানে বেতনটা বেশি। কেরলে শুনেছি, আমাদের বাড়িতে একজন মাছ দিতে আসত, আমার বড়দার খুব প্রিয় ছিল, মাছ বাড়িতে এসে কেটে দিয়ে যেত। হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা হল, মাস ছয়েক দেখা পাইনি, বলল, আমি কেরল গিয়েছিলাম লেবারের কাজে। ওই কাজে পাঁচশো টাকা মজুরি। একস্ট্রা কাজ করলে তার ওপর আবার একটা টাকা। বলল, ওখানে সরু চালের ভাত খাই, একটু আলু ভাতে দিলাম, হয়ে গেল।
আমাদের এখানে এখন লেবারের মজুরি আড়াইশো টাকা। বামফ্রন্ট আমল থেকে দু কিলো চাল দিতেই হবে, তার সঙ্গে মজুরি। মজুরিটা বাড়তে বাড়তে দেড়শো টাকা আর দু কিলো চালের বদলে আরও ষাট টাকা। গড় দুশো টাকা করে দিতে হয় লেবারদের। আবার হয় কী, যখন লেবার পাওয়া যায় না, তখন সে জায়গায় কেউ দুশো কুড়ি বা তিরিশ দিল, সেখানে চলে গেল। আগের থেকে কাজ এখন অনেক কম হয়ে গেছে। তার মানে আমাদের ওখানে বীজতলার জন্য বীজ আঁটি করা হয়, কুড়ি আঁটি বীজ হয়। ওইটা করলে একটা লেবারের মজুরি পাওয়া যায়। একটা লেবার দুটো-তিনটে ওইরকম করে নিচ্ছে। এখন লেবাররা সেই সকালবেলা সাতটার সময় যাবে, ওইখানে খাবে, খেয়ে আবার তিনটে অবধি কাজ করবে, এটা হয় না। তাও কী, ওই লেবার হলেও আটটার সময় যাবে, নটা-দশটা-বারোটা অবধি কাজ করবে, তারপর জল খেয়ে নিয়ে দুটোর মধ্যে কাজ কমপ্লিট করবে।
আমাদের নদীর ওপারে খণ্ডকোষ ব্লকটায় বেশি চাষ, একটাই। এটেঁল মাটি, বর্ষার চাষটা হয় না। মিনি বা যাদের সাবমার্সিবল আছে, ২৫-৩০-৪০-৫০ বিঘের এলাকা, সেখানে বোরো চাষটা হয় না। বাঁকুড়া থেকে লেবার নিয়ে এসে নিজেদের খামারে রাখল, রেখে তাদেরকে ১৫-২০ দিন কাজ করিয়ে নিল, তারপর ছুটি দিয়ে দিল। আবার যখন ধান পাকবে, তখন তারা আসবে।
আমাদের এখানে লেবার যারা কাজ করে, দু-চার মাইল দূর থেকে মোটরভ্যানে করে চলে এল। যেখানেই কাজ হয়, খুব তড়িঘড়ি হয়। এই কালকে তোমার কতজন লোক লাগবে? এতজন? ঠিক আছে, দিয়ে দেব। ওদের মধ্যে একজন হেড থাকে, সে নিয়ে এল। তাদেরকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিল। তাতে আট-দশ মাইল দূর থেকেও আসে। এরপর এরা অনেকে বসে থাকে। কিংবা কর্ড লাইনে কামারকুণ্ডু, বেগমপুর, এসব এলাকায় সবজি চাষটা হয়, সেখানে এসে লেবার দেয়। ট্রেনে যাই যখন, গাদা ওঠে সব। খুব কম রেটে কাজ করে। যারা ইয়ং ছেলে, ফোর-ফাইভ-সিক্স অবধি পড়েছে, তারা বাইরে চলে যায়।
করোনা হয়ে গ্রামে এখন দু-চারটে ছেলে দেখতে পাবেন। নাহলে গ্রামে আর ছেলেদের পাওয়াই যায় না। সোনার কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ, নানারকম হাতের কাজে চলে যায় বাইরে। সাঁওতালদের ছেলেরাও যায়। আমাদের বাড়িতে একজন কাজ করত, ওরা চলে যায় নাসিকে, পেঁয়াজ, আঙুরের চাষ হয়, ওখানে অনেক বেশি রেট পায়। দু-চার মাস টানা কাজ করে ফিরে আসে।
Leave a Reply