চূর্ণী ভৌমিক, কলকাতা, ১৮ এপ্রিল#
বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটের স্লিপ বিলি করবার কাজ পেয়েছি আমি। দুদিন হল দুপুর রোদে প্রচণ্ড গজগজ করতে করতে বেরচ্ছি। মা দুটো বোতলে জল আর শরবত আলাদা আলাদা করে দিয়ে দিচ্ছে। ছাতা নিয়ে বেরনো যে উচিত এমনকি আমিও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার এতদিনকার এতো কষ্টেরর তৈরি ‘অপার্থিব বাউন্ডুলে’ ইমেজটা ফেল করে যাচ্ছে, ভেতরে থাকা হাঁদাগঙ্গারাম বাবুসোনাটিকে কিছুতেই আর সামলে রাখা যাচ্ছে না।
আমার চেনা রিকশা-কাকু একগাল হেসে বললেন ” দিদিমণি এখন সকালে যাচ্ছেন না, ভোটের ডিউটি?” আমি বলি হুঁ”। তিনি বলেন “ছাতা খোলেননি কেন?” আমি বলতে যাই “আপনিও তো খোলেননি” তারপর যথাসময় সামলে নিয়ে কাষ্ঠ হাসি, “এই তো খুলছি। ” উনি দিব্যি মাথায় ছেঁড়া টুপি পরে হাসতে হাসতে চলে যান যেন রোদ নেইই।
অচেনা লোকেদের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে প্রথমে তো অবস্থা খারাপ। বুক ঢিপঢিপ করছে। করুণ গোবেচারা একটা হাবভাব করে প্রথম বাড়িতে যাই। তারপর ইলেকশন অফিস ও সরকারের কথা বলতেই লোকজন ঘিরে ধরল। জল খাওয়াল, পাখার তলায় বসতে দিল। শুরু হল বাড়ি বাড়ি ঘোরার পালা।
তারমধ্যে কিছু বাড়ির গল্প মনে রাখতে চাই, সেইসব বাড়ির কথাই লিখে রাখছি-
বাড়ি ১-
একটাই ঘরের মধ্যে বিশাল বড় খাট পরিষ্কার চাদর বেছানো।আলমারিতে তিনটে পুরনো ঘড়ি পাশাপাশি রাখা, আর একটা ছেলের ছবি ,পাশেই আলনা। রান্নাবান্নাও হয় সেখানেই, তাই গ্যাসের ওভেন সেই ঘরেই। এককোণে একটা সাইকেল রাখা।মাথার উপর তেকোনা ছাদে সাধ করে কেনা ফ্লুরোসেন্ট চাঁদ তারা সাঁটা। মেঝের উপর কাঁদা উঁচু স্টিলের পাত্রে কাঁচা আম কেটে জলে ভেজানো। পাশে আলু ছাড়ানো হচ্ছে বঁটিতে। গ্যাসের উপর হাঁড়ির ঢাকনা টলমল করছে, এই উথলাল বুঝি। আর বাড়ির দিদি একটা পুরানো ম্যাক্সি পরে ঘর সামলাচ্ছেন। আমার হাত থেকে কাগজ নিলেন, তারপর সেই বাড়ির ১৯জন সদস্যের হয়ে সই করলেন। বললেন পেছন দিকে আরও ঘর রয়েছে তাদের। তারপর বললেন ” আমি এই বাড়িরই মেয়ে তুমি নিশ্চিন্তে আমায় দিয়ে দাও। “বললেন “হাতটা গত মাসে ভেঙ্গে গেছিল তাই লেখাটা একটু খারাপ হল”। হাঁড়ি উথলে উঠল। ওই বাড়ির মেঝেতে বসে কারা যে থালা থালা ভাত খায়!
বাড়ি ২ ও বাড়ি ৩ –
দ্বিতীয় বাড়িতে এক বৃদ্ধ। সে যে কী ভীষণ বৃদ্ধ কী বলব। মাথা ঘাড়ের উপর সত্যি সত্যি ডিগডিগ করে নড়ে। আমায় দরজা খুলে দিতেই পারছেন না। তাঁর স্ত্রী স্নানে গেছেন।
তিনি- শুনছ একটা মেয়ে এসেছে আমি দরজা খুললাম?
বাথরুম থেকে- কী??
তিনি- বলছি দরজাটা খুলছি?
বাথরুম থেকে-(জলের আওয়াজে ঢাকা বক্তব্য)
তিনি- উফ এসব তুমি বুঝবে না বুঝলে?
তারপর তাঁকে বুঝিয়ে উঠতেই পারছি না কিছু, তিনিও আমাকে বুঝিয়ে উঠতে পারছেন না কিছু। মিনিট দশেক পর আমি হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছি যখন পেছন থেকে বললেন- “ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন মা”!
ঠিক তার উলটো দিকের ফ্ল্যাটেই এক বৃদ্ধা, ইনিও ভয়ানক বয়স্ক। আমায় দেখে বললেন “কী, ব্যাটাছেলে নাকি মেয়েছেলে?” আমি বললাম “চুল ছোট মানেই কি ছেলে নাকি গো?” কী হাসি তাঁর! তারপর ঘরে টেনে নিয়ে এলেন, তাঁর মেয়ের গল্প করলেন, বুঝলাম তাঁর প্রিয় বিষয় এইটেই, থামতেই পারেন না আর! আপনি থেকে তুমি তে নেমে গেছে আলাপ। তারপর যেই না বলেছি “সই করতে পারবে?” গেলেন খচে। “আমি সই করতে পারি না? দেখবে?” তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে কমলা সরকার লিখে সে কি রঙবাজী তাঁর! “দেখলে? এই বয়সে চশমা ছাড়া পারবে কেউ?” আমি তখন তাঁর সই এর ভূয়সী প্রশংসা করলাম, তারপর শান্ত হলেন তিনি!!!!
বাড়ি৪-
দরজার গায়ে রয়াল স্ট্যাগ নামক বিখ্যাত পানীয়টির রয় লেখা অংশটা কেটে সাঁটা, যার থেকে বুঝলাম পরিবারের পদবি রায়। দরজাটা অর্ধেক খুলে রাখার জন্য চেন দিয়ে লাগিয়ে একটা ফাঁকা কোকাকোলার বোতল সাইড করে গুজে রাখা হয়েছে। বেল বাজাতে মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক ফোনে ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে একটা শান্তিপুরী গামছা পরে বেরিয়ে এলেন। তারপর আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন “গত ৩৭ বছর ধরে আমি ভোট দিই না, আর কোনদিন দেবোও না।”
চলবে
Leave a Reply