হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহিত ভেমুলা ১৭ জানুয়ারি রবিবার রাত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটি ঘরে আত্মহত্যা করেছেন গলায় ফাঁস দিয়ে। আম্বেদকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (ASA) সদস্য এই তরুণ গবেষক দলিত ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। মুজফফরনগর দাঙ্গার ওপর বানানো একটি তথ্যচিত্র দেখানো নিয়ে হিন্দুত্ববাদী আর এস এস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপির সদস্যদের সঙ্গে বিরোধ হয় তাদের। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বারো দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রহিত সহ পাঁচ গবেষক, প্রত্যেকেই ASA সংগঠনটির সদস্য, তাদের হোস্টেল, ক্যান্টিন প্রভৃতি থেকে তাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তাঁবু খাটিয়ে থাকছিল রহিতরা।
আত্মহত্যার আগে রহিত ভেমুলা কিন্তু একটা সুইসাইড নোট লিখে রেখে গেছে। গোটা নোটটিতে কোথাও বলা নেই যে সে দলিত। দলিত আন্দোলন নিয়ে, উচ্চবর্ণের অত্যাচার নিয়ে, নিজেদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবিচার নিয়ে একটিও কথা বলা নেই। শুধু একবার ASA ‘পরিবার’-এর উল্লেখ আছে। আর একবার আছে — “আর শেষবারের জন্য, জয় ভীম।” বরং অসম্ভব নির্লিপ্ততাতে বলা আছে, “আমি চলে গেলে তার জন্য আমার বন্ধু বা শত্রুদের বিব্রত কোরো না।”
কিন্তু এই সুইসাইড নোটটিতে আরও অনেক কথা বলা আছে।
“আমি বিজ্ঞান ভালোবাসতাম। নক্ষত্র, প্রকৃতি ভালোবাসতাম। কিন্তু তারপরেও আমি মানুষ ভালোবাসতাম এটা না জেনেই যে মানুষ দীর্ঘকাল হলো প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের অনুভবগুলি হাত-ফেরতা। আমাদের ভালোবাসা নির্মিত। আমাদের বিশ্বাসগুলি রাঙানো। আমাদের নিজস্বতার প্রমাণ হলো কৃত্রিম শিল্পকলা। ঘা না খেয়ে ভালোবেসে যাওয়া খুব কঠিন হয়ে গেছে।
মানুষের মূল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপাত সত্ত্বায় এবং আশু সম্ভবনায়। একটা ভোটে। একটা সংখ্যায়। একটা জিনিসে। কখনোই তাকে একটা মন হিসেবে নেওয়া হয় না। নক্ষত্রের কণা দিয়ে গড়া এক মহান সৃষ্টি বলে নেওয়া হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে, কি পড়াশুনা, কি রাস্তাঘাট, কি রাজনীতি, কি বাঁচা-মরায়।”
সভ্য মানুষের অনুভব থেকে বিশ্বাস, রাজনীতি থেকে বাঁচামরা, এমনকি নিজস্বতা — সবকিছুতে কৃত্রিমতার সমালোচনা করেছে রহিত — হাত-ফেরতা, নির্মিত, রাঙানো — এইসব শব্দের ব্যবহারে। ‘এই ঘটনায় আমার প্রেমিকা দুঃখ পেয়েছে তাই আমিও দুঃখ পেয়েছি’ — হাত-ফেরতা অনুভব; ‘কুসুমকলি রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী স্বভাবে নম্র ভদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি মানে যা যা কেউ হলে তাকে ভালোবাসা যায় তাই কুসুমকলিকে ভালোবাসি’ — নির্মিত ভালোবাসা; ‘আমি (বা তুমি) বামপন্থী/মমতাপন্থী/ভেগানপন্থী/মোদীবাদী/আমোদবাদী’ — রাঙানো বিশ্বাস।
রহিতের চিঠিতে তার নিপীড়িত সত্ত্বা নিয়ে কোনো আদিখ্যেতা নেই। নিদারুণ ক্ষোভ আছে। সে ‘দলিত’ হিসেবে পরিচিত হতে চায়নি — “মানুষের মূল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপাত সত্ত্বায় এবং আশু সম্ভবনায়। একটা ভোটে। একটা সংখ্যায়।” যে কোনো নিপীড়িত সত্ত্বার আন্দোলনে একজন নিপীড়িত সত্ত্বার মানুষ অংশ নিতে পারে দুটো জায়গা থেকে — ১) সেই সত্ত্বাকে গৌরবান্বিত করার মাধ্যমে একটা পালটা শভিনিজম তৈরির জায়গা থেকে (কাশ্মীরিয়ত, দলিত ভারত নির্মাণ, মুসলিম জাহান, গোর্খাল্যান্ড, তামিল ইলম প্রভৃতি …) ২) সেই আরোপিত সত্ত্বাকে সামাজিকভাবে অস্বীকার করার জায়গা থেকে। চিঠি পড়ে মনে হয় রহিত এই দ্বিতীয়টায় পড়ে। তার এই চিঠিটিতে কোথাও বাঙ্ময় নেই তাই নিপীড়িত সত্ত্বার কথা, কিন্তু ছেয়ে আছে গোটাটা জুড়ে, শব্দগুলির ফাঁকে ফাঁকে অদৃশ্য শব্দে, পংক্তিগুলির ফাঁকে ফাঁকে অদৃশ্য পংক্তিতে। সত্ত্বার আন্দোলনের মধ্যে থেকে আরোপিত সত্ত্বাগুলির বিলোপের অন্তর্লীন আকুতিই এই সুইসাইড নোটটিকে করে তুলেছে এক অসামান্য রাজনৈতিক নোট।
— শমীক সরকার
Maifuz Ali says
প্রথমটা হলে কোনো সমস্যাই হত না , সে নিয়ের সমাজের মধ্যে একটা জায়গা করে নিতে পারত , দ্বিতীয়টার জন্যই ঝামেলায় পরেছিল। নিজে অস্বীকার করলে তো হয় না , সমাজ তো আর পিছু ছাড়বে না। না নিজের ছেড়ে আসা সমাজে জায়গা করে নিতে পারবে না বৃহৎ (সেই অর্থে বৃহৎ ) সমাজ জায়গা দেবে। প্রতি মুহুর্তে মনে করাতে করাতে যাবে। যারা প্রথমটায় তারা টিকে যায় ,……… দ্বিতীয়টাই ঘর থেকে দুরে দুরে থেকে যেতে হয়। ………..