নয়া কৃষি আইন নিয়ে শান্তিপুরে চাষিদের সাথে কথাবার্তা
সুদীপ দাস। বেলেরমাঠ, বাগআঁচড়া। ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০।#
দেড় বিঘে মত জমিতে ভাগে চাষ করি। ফসলের ভাগ দিতে হয়না, টাকায় আগাম দিতে হয়। বিঘেতে বছরে ছ’-সাত হাজার টাকা লাগে। রিভার পাম্পের জলে চাষ। ছ’মাসে তিনশো টাকা। বোরোর মরশুমে অবশ্য ছ’শো টাকা। ভাই কাকাদের জমি মিলিয়ে আড়াই বিঘে মত একাই চাষ করি। ক’বছর ধরে ফুল চাষ করছিলাম। এখানে গাঁদা ফুলটাই করি। লকডাউনের আগে জমি তৈরি করে গাছ বুনলাম। তারপর লকডাউনে হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেল। সার-বিষ কিনতে গেলে দোকানে বলল, এবার নিতে হবেনা। বিক্রি করতে পারবিনা। আমি না শুনেই সার দিলাম। জমিটায় জোর ছিল। গাছ প্রায় আমার কোমর অবধি লম্বা হয়ে গেল। তারপর আমফান এসে সব গাছ পেটিয়ে দিল। পাশের দশ কাঠাটাও চাষ দিয়ে তৈরি করে রেখেছিলাম ফুল বুনব বলে। কিন্তু ট্রেন বন্ধ। সবাই ফুল চাষ বন্ধ করে দিল। নইলে বাঁশ-বাতা দিয়ে গাছ গুলো খাড়া করে দিতাম। অন্যান্যবার ফুল নিয়ে শান্তিপুর স্টেশনে যেতাম। পাইকারদের কাছে বেচতাম। হাওড়া অবধিও যেতাম ফুল নিয়ে। কার কী হয়েছে বলতে পারবনা, লকডাউন আর আমফানে আমার খুব ক্ষতি হয়ে গেছে।
আমফানের পর গাছ ফেলে দিয়ে সবজি বুনলাম। ওই যে সিম গাছগুলোয় ফুল এসেছে দেখছেন। এখন তো দাম নেই। পরে দেখা যাক কী হয়। এবার পাটের দামও খুব ভালো। কিন্তু ওই যে, লকডাউনের শুরুতে সবাই বলল, মিল-টিল সব বন্ধ। তাই পাট না করে সবজি করলাম।
কৃষি বিল নিয়ে সবাই কথা বলছে শুনছি। টিভিতেও দেখছি। বিরোধীরা খুব প্রতিবাদ করছে আর মোদী বলছে শুনছি, চাষীদের নাকি ভালোই হবে এই বিলে। ব্যাপারটা কী বলুন তো। আপনারা কী বুঝছেন?
বাগান, সবজি, ফুল অন্যান্য চাষ বাদ দিলে প্রায় দুশো বিঘা জমিতে ধান চাষ হয় এখানে। ম্যাক্সিমাম চাষিই পাইকারদের কাছে ধান বিক্রি করে। সরকারি রেটের থেকে দাম বেশ খানিকটা কম। এবছর বোরো ধান তো এখনও বিক্রিই করতে পারলাম না। দাম নেই। গোলায় পড়ে আছে কুড়ি-পঁচিশ বস্তা ধান। এখানে ৮০ শতাংশই ছোট চাষি বা ভাগচাষি। দশ কাঠা – এক বিঘে জমিতে ধান করে খাবে না বেচবে? তাছাড়া কাছাকাছি মান্ডিও তো নেই। ধান উঠলে গ্রামের কোথাও একটা এসে সরকারি লোকেরা ধান কিনে নিয়ে যায়। আমরা দিই না।
আমফানের টাকা এল। যাদের কিছুই ক্ষতি হয়নি, তারা টাকা পেল। অবশ্য সত্যিই খুব ক্ষতি হয়েছে, এমন লোকও দু’একজন পেয়েছে। কুড়ি হাজার টাকা ঢুকল, তো পরেরদিন এসে মেম্বার তিন হাজার টাকা কেটে নিয়ে গেল। আমরা বললাম, ওর থেকে টাকা কেটে না নিয়ে যদি সবাই মিলে আরো দশ হাজার টাকা তুলে দিত, তালে ভালো হত। একশ দিনের কাজ সেই গত বছর থেকে বন্ধ। ওটা চালু থাকলেও একটু সুবিধা হত। আমার অবশ্য কার্ড নেই। আমার এক ছেলে, এবার মাধ্যমিক দেবে আর এক মেয়ে, ম্যাথ অনার্স পড়ে শান্তিপুর কলেজে। মেয়ের পড়ার পেছনেই মাসে দুহাজার টাকা খরচা। সারের দোকানে ওষুধ কিনতে গেলে চার পাঁচশ টাকার নিচে কথা নেই। তখন সব ধারদেনা করতে হয় নয়তো এই হুটহাট টাকা দরকার হলে চাষিরা খাওয়ার ধান থেকেই দু’চার বস্তা বেচে দেয় ফড়েদের কাছে। কৃষিবিলে সত্যি কি লাভ হবে চাষিদের?
নিমগ্ন বিশ্বাস। শান্তিপুর। ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০।#
শান্তিপুর গঙ্গার চর অঞ্চলের আদিবাসী মাহাতো পাড়ায় দেখা হয়ে গেল অমিত মাহাতোর সঙ্গে। কথা হল কৃষি বিল নিয়ে। অমিত একজন ভাগচাষি। সে জমি ও পুকুর লিজ নিয়ে ধান, সবজি ও মাছের চাষ করে। তাকে প্রশ্ন করি, এই কৃষিবিলে কৃষিজ পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন ভাগচাষির অধিকার রক্ষার কথা বলা হচ্ছে, অপরদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে তাকে সরাসরি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা হচ্ছে। এককথায় কর্পোরেট জগতের সরাসরি ঢোকার রাস্তা পাকা করা হচ্ছে। এতে কি চাষির অবস্থা আরো খারাপ হবে? অমিত কিন্তু ফড়ে তথা আড়ৎদারদের পক্ষে দাঁড়ায়। এই আড়ৎদাররাই তো চাষের সময় চাষিকে কিছু অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। সরকারি লোককে তখন আমরা পাব কোথায়? আবার ফসল বিক্রির সময় সরকারি লোকেদের সময় মত পাওয়া যায়না। অগত্যা আড়ৎদারই ভরসা। আর সরকারি প্রতিনিধিরাও নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে সেই আড়ৎদারদের থেকেই কেনে। কারণ সর্ষের ভিতরেই ভূত।
অমিত বলে, কৃষিবিল আসলে চাঁদার বিল না অন্যকিছু তা এখানকার চাষি জানেনা, জানতেও চায়না। সে যেভাবে বোঝে, সেভাবেই চাষ করে। কৃষিদপ্তর আর কৃষকের জমির মধ্যে থেকে যায় অনেক ফাঁক। আর কর্পোরেট? যেখানে অধিকাংশ চাষিই ভাগচাষি, সেখানে কর্পোরেটদের সাথে চাষির চুক্তি হবে কী করে? তাই এ নিয়ে সে ভাবেনা। লকডাউনেই ভাবেনি। আগামিতেও ভাবতে চায়না।
Leave a Reply