শমীক সরকার, ট্রেন এ বিহার এর ওপর দিয়ে যেতে যেতে, ১২ অক্টোবর ২০১৫০#

আমদের ট্রেন সবে গঙ্গা পেরিয়ে , ঝাঁঝাঁ ব্রিজ পেরিয়ে সাসারাম স্টেশন টা পেরিয়েছে. আমি টয়লেট এর কাছে স্মার্ট ফোন টাতে চার্জ দিছি. আমার মাল্টি পিন চার্জার টাকে আর একটা আমার বয়সী ছেলে ব্যবহার করতে শুরু করল . ঝাঁট জ্বললে ও আমিই প্রথম কথা শুরু করলাম – ঐ যে নদীটা গেল সেটার নাম কি.? বলল গঙ্গা.. তারপর কতক টা নিজের মনেই বলতে শুরু করল.
.”আমার চার দাদা. সমস্তীপুরে হোলসেল দোকান. সমস্ত সম্পত্তি ওরা নিজেরা নিয়ে নিল , বললাম দোকানের ভাগ দাও. বলল দোকানের পুঁজি মহাজনের. আর অনেক টাকা দেনা আছে. আমি বললাম, নোক্রী যদি করতে হয় তোমাদের কাছে করব না, বরং নিজে ব্যবসা করব. আজ কত বছর হয়ে গেল, দাদা রা খোঁজ পর্যন্ত নেয় না, আমি বেঁচে আছি কি না.”
কথা শুরু হল টয়লেট এর ধারে ফোনে চার্জ দিতে দিতেই. শেষ ও ওখানে ই.
নাম রাজেশ চৌরাশিয়া. গ্রাম বেথুযা বৌজৌউর. সমস্তীপুর বারো কিলোমিটার. সাইকেলে যাতায়াত করে. শহরে মাস দেড়েক হল একটা দোকান করেছে পান বিড়ি সিগারেট এসবের. মাসে ছয়শ টাকা ভাড়া. সরকারি জমিতে “খোখা” র কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে. কিন্তু যেকোন মুহূর্তে তুলে দিতে পারে.
আগে ফেরি করত চা পাতা থেকে গুটকা. হোলসেল থেকে কিনে বাজারে আসা দেহতীদের বিক্রি করত.
হাতে এখন টাকা নেই , তাহলে সে নিজের মতো করে একটা জায়গা খুঁজে নিতে পারত. সেরকম হলেই রাজেশ সমস্তিপুরেই একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজবে. দেড় হাজার টাকা থাকা আর দেড় হাজার খাওয়া. তাহলে আরেকটু সকাল সকাল দোকানটা খোলা যায়.
রাজেশ এর গ্রামে পনের কাঠা জমি আছে. তাতে পান লাগিয়েছে. এছাড়া তামাক ইত্যাদি ও হয়. সরকারি সেচ নেই. একজনের বোর থেকে ঘন্টায সওয়া শ টাকা খরচ করে জল কিনতে হয়.
সমস্তীপুর এখনও সেচ এর তেমন ব্যবস্থা নেই. তাই ধানের বদলে রবি শস্য বেশি , জানালো রাজেশ. বছর দশেক আগেও এখানে তামাক চাষ হত খুব, কিন্তু একবার খুব ফলন হয় , কিন্তু কোন দাম পাওয়া গেল না , সেই থেকে লোকের তামাক চাষে উতসাহ কমেছে. এখন তামাক লাগালে কতটা জমিতে লাগানো হয়েছে তা সরকার কে জানাতে হয় . এক কাটা জমিতে তিরিশ কেজি তামাক হয়. কেজি প্রতি বাজার মূল্য তিরিশ পঁয়ত্রিশ টাকার মতো. কিন্তু তামাক প্রসেস করে বিক্রি করতে হয় , খাটনি বেশি.
তুলনায় কপি, বেগুন এসবে খাটনি কম. তাই লোকে এসব ই করছে. সোমোস্তীপুরে সবজি মান্দি আছে. সেখানে বিক্রি র জন্য নিয়ে আসতে হয়. তবে আজকাল গ্রামে গ্রামে সবজি মান্দি হয়েছে. এখানে লোকে লঙ্কা , সর্ষে আর আলু ও করে. এখানকার আলু লাল আলু. শীতে বাংলা থেকে সাদা আলু আসে , তার দাম এখানকার আলুর থেকে দু টাকা হলেও কম থাকে.
রাজেশ রা চৌরাশিয়া. মানে পান চাষ এর জাত. সে সাসারাম গেছিল গঙ্গা স্নান করতে. নবরাত্রি উপলক্ষ. আবার যাবে ছট্ পূজা র সময়. বছরে এই দু বার তো যায় ই. ওদের গ্রামের বয়স্ক রা অবশ্য কার্তিক মাসে মাস খানেকের জন্য গঙ্গা পাড়ে তাঁবু খাটিয়ে গঙ্গা স্নান করে , আশেপাশে সাধু সন্ন্যাসী দের ভোগ খাওয়ায.
আজ বিহারে ভোট. বিজেপি কে ভোট দেবে রাজেশ, কারণ ওপরে আর নিচে একই সরকার থাকলে সার্বিক উন্নয়ন হবে. এখনো কোন ভোট মিস করেনি সে , পাঁচবছরে একবার ই তো সুযোগ মেলে , জানে পার্টি তার কথা শুনবে না, তবু…
তার দাদা দের ছেলেরা সব হোস্টেল এ থেকে পড়াশুনা শিখছে. তার এক ছেলে এক মেয়ে. ছেলে বড়, সাত বছর বয়স, মেয়ের চার. ওরা পড়ে ওর গ্রামের সরকারি স্কুলে, সেখানে পড়াশুনা হয় না, খায় দায়. প্রাইভেট স্কুলে তা ও কিছু পড়াশুনা হয়. দাদাদের কথায় রাজেশ ক্লাস টেন ওব্দি পড়ে পারিবারিক ব্যবসা য শামিল হয়েছিল, যদি গ্রাজুয়েশন করা থাকত থাকত তাহলে ঠিক পনের কুড়ি হাজারের একটা কাজ সে জুটিয়ে নিতে পারত. ব্যবসা স্বাধীন, কিন্তু তাতে ইনকাম কম.
কথায় কথায় এসে গেল সোমোস্তীপুর স্টেশন. চার্জার খুলতে গিয়ে রাজেশ এর ফোন টা আমার হাত থেকে পরে গিয়ে খারাপ হয়ে গেল. কিছুক্ষণ নীরবতা. তারপর সে নিজেই বলল, চাইনিজ মাল তো, ঠিক করাতে হবে, আজকাল মোবইল ছাড়া চলা যায় না. আমার ফোন নম্বর চেয়ে লিখে নিল কাগজে. আমিও ওর টা লিখে নিলাম আমার মোবাইল এ. তারপর ব্যাগটা কাঁধ এ নিয়ে নেমে গেল.
নেমে যেতে মনে পড়ল,ওই যা, একটা ছবি তোলা হল না তো.? স্মার্ট ফোনের অভ্যেস টা এখনো হয়নি. দ্রুত পায়ে স্টেশন এ নামলাম. কিন্তু রাজেশ কে আর দেখতে পেলাম না.
একটি আন্তরিক লেখা। কিন্তু এই জায়গায় একটু অস্বস্তি লাগল: ‘‘ঝাঁট জ্বললে ও আমিই প্রথম কথা শুরু করলাম…’’।
সংবাদপত্রে এই ভাষা প্রত্যাশিত নয়।
আর একটা কথা, পুরো লেখাটায় কোথাও দাঁড়ি দেখলাম না। তার বদলে রয়েছে ডট। এটা সংবাদমন্থনের ওয়েবসাইটের সমস্যা নাকি আমারই কম্পিউটারের ফন্টের গোলমাল, বোঝা গেল না।
ট্রেন-এ বসে আমার ফোন থেকে টাইপ করেছি, যে কী-বোর্ড ব্যবহার করেছি, সেখানে দাঁড়ি নেই। ডট-টা হয়েছে তাই।