সৌজন্যে, আমরা সবাই দাদার অনুগামী
পর্ণব। হলদিয়া। ১২ নভেম্বর, ২০২০।#
পূর্ব মেদিনীপুরের শিল্পবন্দর হলদিয়ার এক্সাইড ব্যাটারি কারখানার শ্রমিকদের চাপা ক্ষোভের কথা কানে আসছিল বেশ কিছুদিন ধরে। শ্রমিকরা কেন নিজেদের অভাব অভিযোগ দাবীদাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে জানাতে পারছেন না, তা জানতে চাইলে ওই কারখানার এক প্রাক্তন ইউনিয়ন-নেতা জানালেন, শ্রমিকদের স্বার্থেই চুপ করে গেছি। চুপ থেকেও একটা আন্দোলন হয়।
রায়চক জেটি ঘাটে দুপুর দেড়টার কুকড়াহাটিগামী ফেরি আসতে মিনিট চল্লিশ দেরি। এক জেটিকর্মী ব্লুটুথ স্পিকারে এক হরিসভার রেকর্ড শুনছিলেন তারস্বরে। মুসলমানদের ধর্মশিক্ষার জন্য মাদ্রাসা আছে। হিন্দুদের জন্য স্কুলে কলেজে কেন ধর্মশিক্ষার ক্লাস থাকবে না? নানা সুরে হরি নামের সাথে এসবও আসছিল কানে। মাছের টক দিয়ে কুকড়াহাটির হোটেলে ভাত খেয়ে টানটান একুশ কিলোমিটার বন্দর শহর হলদিয়া। হাওয়ায় অ্যামোনিয়ার চাপা গন্ধ। রিফাইনারির চিমনিগুলোয় দমকে দমকে বেড়ে উঠছে আগুনের শিখা।
সেদিন এক্সাইডের মেন গেটের বাইরে মিটিং করার কথা ছিল শ্রমিকদের। বিকেলে পুলিশ পোস্টিংও হয়ে গেছিল। রাত এগারটায় করোনার অজুহাতে মিটিং স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দাদা এসেছিলেন সেদিন। এসেছিলেন দাদার অনুগামী দলও। কনট্রাক্টর ইউনিয়নের বাইরের জমায়েতে জিজ্ঞাসাবাদ করে সদুত্তর পাওয়া গেল না। ঝান্ডাহীন তরুনের দল বললেন, এসেছেন যখন, দাদা এলে বিরিয়ানি খান। মাপেজোকে মিললে এক্সাইডে কাজে ঢোকার চান্সও পেয়ে যেতে পারেন। হেমন্তের আকাশের মত ধোঁয়াশা রয়ে গেল মনে। গোটা হলদিয়া শহরের পথে পথেই ‘আমরা দাদার অনুগামী’ লেখা শুভেন্দু অধিকারীর ছবির পেল্লাই সাইজের হোর্ডিং, কাটআউট।
লাঞ্চ ব্রেকে এক শ্রমিক কথা বলতে চাইলেন। কারখানা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রাণীচক বাসস্ট্যান্ডে। চোখে মুখে ভয়। অবিশ্বাস। যা জানা গেল, অন্যান্য শ্রমিকদেরও যা বক্তব্য, ১৯৯৬ থেকে এই ব্যাটারি কারখানা ইঞ্জিনিয়ারিং স্টেটাসেই চলছে। অথচ অ্যাসিড, লেড অক্সাইডের মত মারাত্মক সব কেমিক্যাল নিয়ে ওনাদের কাজ। বহু শ্রমিক কাজের মেয়াদ ফুরনোর আগেই এঁকেবেঁকে চলতে শুরু করেন। যতই মাস্ক পরুন না কেন, পরীক্ষা করলে শরীরে লেডের পরিমাণ পাওয়া যায় বিপদসীমার উপরে। আটঘন্টায় যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ। বিশেষত যারা অ্যাসেম্বলি বা ডিজাইনিং বিভাগে কাজ করেন। বেশিরভাগ কাজই ম্যানুয়ালি করতে হয়। এক একটা সেলের ওজন মিনিমাম পাঁচ ছয় কিলো। হলদিয়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাথা হিসেবে মন্ত্রী শুভেন্দু ওই শিল্পতালুকের প্রায় সব কারখানার ইউনিয়িনের সভাপতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই শ্রমিক বলেন, এমপ্লয়ি না হয়েও একজন রাজনৈতিক নেতা কী করে ইউনিয়নের সভাপতি থাকে বলুন তো? এখানে সব নিয়োগই দাদা ধরে হয়। আগে তাও ক্যাজুয়ালদের মধ্যে থেকেই পার্মানেন্ট স্টাফ নেওয়া হত। এখন পয়সা ছাড়া কোনোকিছুই সম্ভব নয়। যারা বারো চোদ্দ বছর ক্যাজুয়াল হিসেবে কাজ করল, তাদের অগ্রাধিকার থাকে কিনা বলুন। বলতে গেলেই হয়তো শ্যুট করে দেবে। নয়তো ছাঁটাই। নয়তো কেস দিয়ে দেবে। এমনকি পরিবারের লোকেদেরও।
২০১৫ এ শেষবার ইউনিয়ন ইলেকশন হয়। তাও দল থেকেই পঁয়তাল্লিশ জনের নাম ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ঊনিশজন নির্বাচিত হয়। বাম আমলে সিটুর রাজত্বে তিনবছরের জন্য চার্টার হত। সেটা এখন পাঁচ বছর হয়েছে। মূলত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উপর ভিত্তি করেই চার্টার হয়। কিন্তু এখনকার ম্যানেজমেন্ট নিজেদের স্বার্থ, পদোন্নতির জন্য যে নর্মস বা টার্গেট দিচ্ছে, সেটা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমাদের প্রধান দাবী সম কাজে সম বেতন। ২০১৪, ২০১৭ আর ১৯ এ যে সমস্ত নিয়োগ হয়েছে, সেখানে ভয়ানক বেতন বৈষম্য। একই কাজে ‘১৪ এর আগে নিযুক্তদের যেখানে আটত্রিশ হাজার মাসিক স্যালারি, আমাদের সেখানে তের হাজার সাতশ। ওদের ইন্সেন্টিভ সাড়ে চারশ। আমাদের সত্তর টাকা। তার ওপর ওভার টাইম করতে বাধ্য করা। বিষাক্ত কেমিক্যাল নিয়ে কাজ বলে আমরা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বেরতে চাই। তাই নর্মসের দোহাই দিয়ে বাকি সময়টাও খাটিয়ে নিতে চায়। পুরনো শ্রমিকরাও এই বেতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তারা বললেন, ম্যানেজমেন্ট আর বাইরের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হয়ে গেছে একে অপরের পরিপূরক। ভেতরেও নেতৃত্ব দেবার মত কেউ নেই। যেটুকু কাজ আছে, সেটাও হারানোর ভয়ে।
ফেরার পথে ভেসেলে শুনছিলাম, জেটিতে এখন রোজ কড়া চেকিং চলছে। নানারকম অস্ত্র লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকছে নাকি বন্দর শহরে।
Leave a Reply