কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল ও শমীক সরকার, মান্দারিয়া, আমতা, হাওড়া, ৭ মে ২০১৬#
বড়ো মিডিয়া খবরটা আগেই করেছিল। আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম তার পেছনে ফেলে যাওয়া ঘর পরিবারের উদ্দেশ্যে। দিনটা ছিল শনিবার, ৭ মে ২০১৬। বিদ্যাসাগর সেতুর টোল ট্যাক্স থেকে একটা এক্সপ্রেস বাস ধরে রাণিহাটি। সেখান থেকে একটা রুটের বাস ধরে আমতা, আমতা থেকে একটা টোটো ধরে আমতার বিখ্যাত ঠাকুর মেলাইচণ্ডী, বাজার এলাকাকে পেছনে ফেলে টোটো গ্রামের পথ ধরল। টোটোচালক সন্তু পাত্রকে বলতেই সে চিনতে পারল — বলল, ও ভ্যান চালাতো না। জন খাটত। তবে বাড়িটা ঠিক চিনি না।
জায়গাটার নাম মান্দারিয়া পার্ক, একটা ছোটো পিকনিক স্পট আছে। গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতেই তারা বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। পিচের রাস্তা থেকে এবড়ো খেবড়ো মাটির পথ ধরে একটু নেমে আসতে হয়। এক মহিলা বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। এক বৃদ্ধা ঠাকুমা এসে মাদুর পেতে ঘরের দাওয়ায় বসতে দিলেন। খড়ের চাল, মাটির দাওয়া, সামনের খোলা দরজা দিয়ে ঘরের খানিকটা অংশ দৃশ্যমান। একটা চৌকি, জামাকাপড়, জনখাটা মানুষের ঘর-গেরস্থালী। এই হলো নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যাওয়া স্বরূপ সাঁতরা (৩৮) র ঘর। আমাদের পশ্চিমবাংলায় এবছর (হয়ত) প্রথম ঘটে যাওয়া গরমের বলি। স্বরূপ সাঁতরা।
আমাদের ঘড়িতে সময়টা তখন বারোটা তিরিশ আন্দাজ হবে। বললাম, ঘরে তাদের কে আছে এখন? বৃদ্ধা মানুষটি বললেন, ওরা তো এখন কেউ নেই বাবা, একশো দিনের কাজে জন খাটতে গেছে। কে? ওনার স্ত্রী? স্ত্রী কোথায় বাবা, স্বরূপের বৌ তো তিনবছর আগে বরের সঙ্গে অশান্তি করে নিজেকে নষ্ট করল। আমরা তাকিয়ে আছি দেখে আবার বললেন, সে মেয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মোলো যে বাবা। অশান্তির কারণ জানার জন্য আমরা জিজ্ঞেস করি। উত্তর আসে, স্বরূপ যে খুব নেশা করত বাবা। মোটে কথা শুনত না। স্বরূপের দাদাও তো ওই করে বছর তিনেক আগে নিজেকে নষ্ট করল।
ওরা বারবার মৃত্যু শব্দটার পরিবর্তে নষ্ট শব্দটা ব্যবহার করছিলেন। কাছেই সেই দাদার স্ত্রীও দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমতার এক বাড়িতে ঠিকে কাজ করেন। তার দুই মেয়ে।
— তাহলে জন খাটতে গেছে কে?
— কেন স্বরূপের মা। স্বরূপের তিন মেয়েকে নিয়ে।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে বলি, তাই?
— নাহলে কী খাবে ঘরে বাবা? পেট চলবে কী করে? পাশ থেকে একজন মহিলা (যিনি ঘর দেখিয়ে দিয়েছিলেন), সংশোধন করে দেন, ‘একশো দিনের কাজে খাটতে গেছে। এই এসে পড়বে। সময় হয়ে এলো।’
শমীক জিজ্ঞেস করে, এদের জমি-জায়গা নেই?
— না বাবা। আসলে আমরা এদের জ্ঞাতি। আমাদের ওই ওদিকে বাঁধের গায়ে ঘর ছিল। আটাত্তর সালের বন্যায় আমাদের সব গেল। আমরা এপারে এলাম। তারপর ঘর দুয়োর করে বন্যার পর আবার ফিরে গেলাম। আমরা ভাগ চাষি, ভাগে চাষ করি। স্বরূপরা আরো গরীব বাবা। ওরা ভাগে জমিও পায়নি। তাই এই খাস জমিতে ঘর করে রয়ে গেল। আর জন খাটতে রইল।
তারপর কথায় কথায় বলেন, এরা মা-ছেলে তো ছিল না। এই তো সবে কিছুদিন হলো এয়েছিল। কেন কোথায় গিয়েছিল? জেলে গিয়েছিল কয়েক মাসের জন্য।
— জেলে গিয়েছিল?
— হ্যাঁ বাবা; জমি নিয়ে বিবাদে জ্ঞাতিরা মামলা করেছিল তো। আমি ভাবি, যাদের জমিই নেই, জনখাটা মানুষ, তাদের আবার মামলা মকদ্দমা কি। শমীক পরে বলল, ও ওই সময় একজনকে বলতে শুনেছে, বৌটা পুড়ে মারা যাওয়ার জন্য …।
— তো স্বরূপের মেয়েরা কোথায় ছিল?
— মামার বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিল বাবা। এবারও তো স্বরূপ মারা যেতে মামারা নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেয়েরা ঠাকুমাকে ছেড়ে থাকতে চাইলে না। তারা চলে এলে।
এসব কথা হতে হতে স্বরূপের মা চলে আসে। তার সঙ্গে তিন নাতনিও এসে দাঁড়ায়। ফুটফুটে মিষ্টি তিন মেয়ে। স্বরূপ সাঁতরার মা দাওয়ায় এসে বসেন। রোদের পোড়া শক্তপোক্ত স্বাস্থ্যের মানুষটির মুখে গভীর বিষণ্ণতা। নাম তার তিলকা সাঁতরা। জিজ্ঞেস করায় বলেন, ছেলের বয়স হয়েছিল বছর আটত্রিশ।
— আপনি গিয়েছিলেন কোথায়? ওই যে বাবা, একশ দিনের কাজে ডেকে নিয়ে গেল। জল তোলা কাজ। আমি আর কী করে করব। আমার নাতনিরাই পালা করে জল তুলে দিলে।
— রোজ কত আপনার?
— ওই একশ সত্তর টাকা। পাশ থেকে একজন বলে, একশ’ পঁচাত্তর।
নাতনিদের নাম জিজ্ঞেস করি। একে একে তারা পরিচয় দেয় — বড়োটির নাম প্রসাদী সাঁতরা (১২), পড়ে ক্লাস সেভেন-এ। মেজো বোন সুনীতা সাঁতরা (৯), পড়ে ক্লাস ফাইভে। দু-জনেরই স্কুল, যোধকল্যাণ পুষ্পরাণী বিদ্যালয়। আর তাদের ছোট্ট বোনটির নাম সুস্মিতা সাঁতরা (৭)। পড়ে ক্লাস থ্রি-তে, কাছেই প্রাইমারি স্কুলে। সেই জ্ঞাতি বৃদ্ধা বলেন, তিন বোন স্কুলে যায় বলে তবু দুপুরবেলার খাবারটা জোটে স্কুলে। ছোটোটিকে জিজ্ঞাসা করি, স্কুলে কী খেতে দেয়? মেয়েটি টেনে টেনে বলে, ডাল, ভাত, তরকারি, মাছ।
আমরা জিজ্ঞাসা করি, মাসিমা ছেলে আপনার মারা গেল কী করে? তিলকা বলে, ওই তো বাবা, ছেলে তো নেশা করত খুব। আগে বেশি করত না। কিন্তু বৌটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর স্বরূপ বেশি বেশি নেশা করতে শুরু করল। তার মধ্যে ওই খাটনি।
— এবার জন খাটতে গেল কুমারিয়ার মাঠে। আমাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। দিনে ধান কাটা — রাতে ধান ঝাড়া। এমনিতে আড়াইশো টাকা রোজ। এটা ডবল রোজের কাজ। গরম পড়েছিল খুব। টানা ন’দিন কাজ করার পর অনেকেই কাজ করতে পারেনি। ছেড়ে চলে গেছিল। আমার ছেলে দশ দিন কাজ করার পরে এগারো দিনের দিনেও কাজে গেল। কিন্তু সন্ধেয় বাড়ি ফিরল না। রাতে মাঠে খোঁজাখুঁজি করে পাইনি। সকালে একজন দেখতে পেয়ে খবর দিতে, গিয়ে দেখি ছেলে আমার হাত দুটো ছড়িয়ে চিতিয়ে মাঠে পড়ে আছে (অঙ্গভঙ্গী করে দেখান তিলকা)। চোখ আর কান দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। জুতো দুটো কোমরের তলায় গোঁজা। ছেলে মোটেই জুতো পা থেকে ছাড়তে চাইতো না। বলত, কেউ নিয়ে নেবে। আর পাঁচশো টাকার মতো ছেলের কাছে ছিল। ওই ক’দিন কাজ করে হাজার এগারোশো টাকার মতো হাতে পেয়েছিল। একবার আড়াইশো টাকা, আর একবার পাঁচশো টাকা দিয়েছিল আমার হাতে। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধার গলা বুঁজিয়ে আসে। বলেন, ‘ছেলে বলত, “মা, দেখিস ঠিক একদিন তোর স্বরূপবালা পাখি হয়ে আকাশে উড়ে যাবে। আর আসবে না'”। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।
স্বরূপের শরীরটা পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে পোস্ট মর্টেম করেছিল। এখনও রিপোর্ট আসেনি। স্বরূপের দেহ উদ্ধার হয়েছে মঙ্গলবার (৩ মে) সকালে।
তিন বোন দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা উঁচু রাস্তায় উঠে টোটোয় চড়ে বসি।
Leave a Reply