শ্যামল প্রামাণিক, ৩০ অক্টোবর#
নদিয়া জেলার কালীগঞ্জ থানার জুড়ানপুর অঞ্চলে ছুটিপুর, জুড়ানপুর, আদমপুর, ছোটো ইতনা, বড়ো ইতনা প্রভৃতি গ্রাম। এখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বসবাস পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে দীর্ঘদিন চলে আসছে। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি উভয় সম্প্রদায়ের সুন্দর সম্পর্ক। মাচায় বসে একসঙ্গে গালগল্প, শীতের দিনে আগুন পোয়ানো, যাত্রা জরিনা সাগরভাসা প্রভৃতি গানবাজনা একসঙ্গে করা নিত্যদিনের স্বাভাবিক ছবি। রথের মেলায় মুসলমান পাড়া থেকে আসত হিন্দু মেয়েরা। আবার হিন্দু ঘরের ছেলেমেয়েরা মহরমের ঘোড়ার নাচ দেখতে গিয়ে মুসলমান পাড়ার মেলায় পাপড় ভাজা খেত। এই দৃশ্য হামেশাই চোখে পড়ত। ১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে ক্রমশ পরিস্থিতি পালটাতে থাকে। ফরিডতলা গ্রামের পিছনদিকের সড়ক রাস্তা দিয়ে গিয়ে যেখানে পীরের ছোট্টো কবর আছে, সেই মাঠে হিন্দু ছেলেদের সারাবছর খেলাধূলা করতে দেখেছি। আবার সেখানেই মুসলমানরা মহরমের দিনে দু-ঘণ্টা লাঠি খেলা করত। তাতেও সকলেই উপভোগ করত। মাঠটার চারদিকে হিন্দু বসতি ক্রমে বেড়ে উঠেছে। শোনা যায়, মাঠটা সরকারি খাসের সম্পত্তি।
ছুটিপুরের গৌরবাড়ির দেবোত্তর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বেশিটাই সেবায়েতের নিজ স্বার্থে চাষের জন্য মুসলমান চাষিদের ভাগে দেওয়া হয়েছিল। কিছুটা বেনিয়মে বিক্রিও করা হয়েছিল। প্রথম প্রথম ধানের ভাগ পাওয়া যেত। ক্রমে অধিকাংশ সম্পত্তি জবর দখল হয়ে যাওয়ায় ভাগ দেওয়া মোটামুটি বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে হিন্দু মানসে একটা চাপা অভিমান ছিল।
অন্যদিকে জুড়ানপুর গ্রামে দেড়-দু দশক আগে মুসলমান জনসমষ্টি খুবই নগণ্য ছিল। নদিয়া বীরভূম বর্ধমান মুর্শিদাবাদের সীমান্ত অঞ্চলে জুড়ানপুরের বিখ্যাত কালীপীঠ থাকায় মুসলমানরা নিজেদের কুরবানি পাশের গ্রাম ছুটিপুর থেকে করে আনত। এখন মুসলমান জনগোষ্ঠী ওই গ্রামে কুরবানি করতে চাইছে। এটা নিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে একটা মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। প্রশাসন এসে একটা সমাধান করে। পুরোনো নিয়মই বহাল থাকে। এতে মুসলমান বাসিন্দাদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা মনে করে যে আমরা অনেক লোক এই গ্রামে বাস করছি, তাহলে আমরা কেন এখানেই আমাদের কুরবানি দিতে পারব না।
গত দু-বছর আগে এখানে একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়। সড়কের পাশে দু-তিনজন মানুষ বিকেলে নামাজ পড়ছিল। সেটা ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন। পাশের গ্রামের কিছু লোক ওই সড়ক ধরে ঢোল ডগর বাজাতে বাজাতে পাঁঠা সহকারে কাটোয়া স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল। নামাজে পাঠে বিঘ্ন ঘটছে বলে বাজনা বাজানো বন্ধ করতে বলে নামাজিরা। এটা না শোনায় দুইপক্ষের মধ্যে একটা বচসা বাঁধে।
দীর্ঘকাল যাবৎ চারটে জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ ঢোল ডগর বাঁশি এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জামালপুরে পাঁঠা পুজো দিতে যায়। আমার মনে হয় যে জামালপুরে কোনো মূর্তি না থাকায় বৌদ্ধস্থান দখলের চিন্তা থেকেই এইভাবে যাওয়ার রীতি চলে আসছে। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনেই ধর্মরাজের মূল পুজো হয়। পাঁঠা নিয়ে যাওয়ার সময় এতদঞ্চলে গ্রাম্য বিবাদের বহিঃপ্রকাশও ঘটে এসেছে।
এবছর সুজাপুর রঘুপুর নারায়ণপুর এবং জুড়ানপুরের লোকজন সন্ধ্যের পরে পুজো নিয়ে জুড়ানপুরের ভিতর দিয়ে একসঙ্গে জামালপুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যে থেকে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় সকলে একজোট হতে পারেনি। সন্ধ্যের পরে ঢোল ডগর নিয়ে জুড়ানপুরের লোকেরা বেরিয়ে আসে কাটোয়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে। এমন সময় জুড়ানপুরের মসজিদের কাছে আসতেই প্রচণ্ড বোমা বিস্ফোরণ হতে শুরু করে। পরে গ্রাম জুড়ে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। গ্রামে আগে থেকে পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকী কালীগঞ্জ থানা থেকেও এই বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে যারা পুজো দিয়ে ফিরে আসছিল, তারাও বোমাবাজির মধ্যে পড়ে যায়। তখন ঘরবাড়ি লুঠ, ফসলের জমিতে আগুন দেওয়া এবং বাড়ি চড়াও হয়ে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটে যায়। নওদা গ্রামে হাজরা পরিবারের তিনজন মারা যায় এবং কয়েকজন গুরুতরভাবে জখম হয় গুলিবিদ্ধ হয়ে।
ধর্মরাজের পুজো বা মহরম নিয়ে আগে যে সহনশীলতা ছিল গ্রামসমাজে, সেখানে একটা রেষারেষি তৈরি হচ্ছে। এটা সামগ্রিক চিত্র না হলেও ওইসব অঞ্চল বিশেষে এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়।
Leave a Reply