গৌরী দাস, ৫ ডিসেম্বর#
“এপার বাংলা ওপার বাংলা মাঝখানে কাঁটাতার
গুলি খেয়ে ঝুলে থাকলে ফেলানি বলো তো দোষটা কার ?”
দোষটা কার ? আমরা সবাই জানি ? আমরা চুপ করে থাকি। চুপ করে থাকা আমাদের ধর্ম। আমাদের বড় হয়ে ওঠা। যদি চুপ করে না থাকি, যদি চিৎকার করে ফেলি হঠাৎ – তাহলে ? আমাদের ফেলানির মতো গুলি খেয়ে মরতে হবে ! অথচ সত্যিটা সত্যিই। কেউ কোনোদিন এই সত্যিটা মুছে ফেলতে পারবে না। আমাকে যেমন দুভাগ করে ফেললেও আমি আমিই থাকব। আমার আর একটা অংশের অন্য নাম হবে না কখনই। আর যদি হয় সেটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে। সেরকমই বাংলাকে ভাগ করে এপার বাংলা ওপার বাংলা করা যায়। তবু বাংলাটা বাংলাই রয়ে যায়। আমি যখন কাঁটাতারের এপাশে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেই সময় হয়ত আমার মতোই একটা মেয়ে কাঁটাতারের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। ও হয়তো আমার মতো এপারকে দেখছে, ছুঁতে চাইছে। হয়তো কোনো পরিজনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা কেউ কাউকে ছুঁতে পারছি না, দেখতে পারছি না। কাঁটাতার আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করা যায়? হয়তো যায়। তবু, আমি নিশ্চিত, আমাদের মনের অনুভূতিগুলোকে কোন কাঁটাতারই আলাদা করতে পারবে না। বরং যত আড়াল রাখার চেষ্টা করবে ততই অনুভূতিগুলো বাড়তে থাকবে।
এই ভাবে দেশ, তারপর সমাজ, পরিবার আমাদের আটকে রাখার চেষ্টা করে সারাক্ষণ। কিন্তু আমরা যারা এখনো অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করি তারা সবাই বছরের এই সময়টা, দুর্গা পুজোর পরে সাতদিন এক জায়গায় মিলিত হই।
ছোটো মেজো বড়ো অনেকেই থাকেন এই কর্মশালায়। মূলত ছোটোদের নিয়ে এই কর্মশালার আয়োজন বলে এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শিশু কিশোর বিকাশ মেলা’। আমরা বলি ‘শিশুমেলা’।
আমরা যারা ‘বড়ো’ তারা ভাবি শিশুদের ‘বিকাশ’ হওয়া প্রয়োজন। নানা দিক দিয়ে। যেমন সমাজ, রাজনীতি, নাচ, গান আবৃত্তি, নাটক, যুক্তিতর্ক ইত্যাদি বিষয়ে। তাই আমরা শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপাদান জোগান দিতে থাকি — কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত বা কী করলে আমরা ভালো থাকব, সুস্থ ভাবে জীবন যাপন করতে পারব — এইসব। জানি না কতটা সফল হয় কতটা হয় না। হয়তো সেই মুহূর্তে কিছু হয় না, পরে এর ফল দেখা যায়।
গত পাঁচ বছর ধরে এই কর্মশালায় আমি অংশগ্রহণ করছি। এই পাঁচ বছরে আমি দেখেছি শিশুদের মধ্যে ( যাদের বয়স পাঁচ থেকে ষোলো বছর ) নিজে কিছু করে দেখানোর প্রবণতা খুব বেশি। যেদিন কাটুমকুটুম তৈরি হয় অর্থাৎ ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে নতুন কিছু গড়ে তোলা হয় সে দিন ছেলেমেয়েগুলো অসাধারণ সব সৃষ্টি করে যা তাবড় তাবড় বড়োদের মাথায় আসবে না। যেমন খুশি সাজার দিন এমন সব সাজে সেজে ওঠে তারা — কোথায় লাগে বড়ো বড়ো ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করা ডিজাইনারদের ফ্যাশন। কৃত্রিম রঙ ছাড়া প্রকৃতির রঙ দিয়ে আঁকা হয় যেদিন, সেদিন দেখা যায় তাদের অভাবনীয় কল্পনাশক্তি ও আবিষ্কারের মিশেল। বড়োরাও এসব কাজে বিনা দ্বিধায় অতি উৎসাহে কাজগুলো করেন। কিন্তু এ বছর প্রকৃতির রঙ দিয়ে আঁকার কাজটা হয়নি। এবারে কাগজ দিয়ে ব্যাঙ বানানো হয়েছিল আর সেটাও খুব মজার হয়েছিল।
এছাড়া প্রতি বছর যা হয় — প্রথমদিন সকালে গিয়ে স্কুলবাড়ি পরিষ্কার করা — বিকেলের মধ্যে প্রায় সবাই চলে আসে, তাদের নিয়ে একটা বড়ো হল ঘরে বসা — সেই ঘরটা অবশ্য পরের সাত দিনের জন্য ‘গানের ঘর’ হয়ে যায়। পরের দিন সকালে ছটায় গ্রাম ঘুরতে যাওয়া, ফিরে এসে চা বিস্কুট খেয়ে গানের ঘরে জড়ো হওয়া, কিছু পুরোনো গান গাওয়া আর একটা নতুন গান শেখা, তারপর সকলে গোল হয়ে দাঁড়ান এবং বয়স অনুযায়ী দল ভাগ করা। একদম ছোটো যারা, যাদের বয়স পাঁচ থেকে দশ বছর তাদের একটা দল — এবারে তাদের দলের নাম ‘ললিপপ’। এগারো থেকে তেরো বছরের দলের নাম ‘মহারাজ’, চোদ্দ থেকে পনেরোর দল ‘শ্রেষ্ঠ জুনিয়র’ আর ষোল থেকে সত্তর বছরের দলের নাম ‘ক্যান্ডি-প’।
এই দলগুলো যে যার ঘরে চলে যায়। কী নিয়ে কাজ হবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। যেখানে মেলা বসেছে সেখানকার সমাজ, পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা — এরকম কিছু একটা বিষয় নিয়েও কাজ হতে পারে। কাজ করানো শুরু করেন মাস্টার বড়োরা — অনেক দিন শিশুমেলা করাতে করাতে ছোটোদের কাজ নিয়ে যাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁরা। এবারের বিষয় ছিল ‘আমার বাড়ি, সমাজ, দেশ’।
আমি দু-বছর ধরে বাচ্চাদের ঘরে কাজ করার দায়িত্বে থাকা মাস্টার বড়োদের সহযোগী হয়ে থাকার সুযোগ পাই। কেন পাই জানি না। আমার ছোটোদের নিয়ে কাজ করানোর কোনো যোগ্যতা নেই। তবে বাচ্চাদের সাথে থাকতে থাকতে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। আমি বহুবার বড়োদের সাথে থিয়েটার করেছি, এখনো করে চলেছি। এটাই হয়তো আমাকে ওদের সাথে থাকার সুযোগ করে দেয়। আমাকে এই সুযোগ দেওয়ার জন্য শিশুমেলার বড়োদের অনেক ধন্যবাদ।
আমি আর একজন — আমরা দুজন একসঙ্গে ললিপপদের ঘরে ছিলাম। প্রথমদিন যা হয় — আলাপ পরিচয়, কিছু খেলা আর চারটে দল ভাগ করে দু’মিনিটের নাটক তৈরি — ইত্যাদি দিয়ে কাটল। দ্বিতীয় দিন আমরা চলে গেলাম মহারাজদের ঘরে। ললিপপদের ঘরে গেলেন অন্য দু-তিন জন। ‘আমার বাড়ি’ বললে প্রথমে কী মনে হয় — মহারাজদের বললাম একটা কাগজে লিখে দিতে। অসাধারণ লেখা বেড়িয়ে এল বাচ্চাদের কলম থেকে। কেউ লিখেছে, মা। কেউবা লিখেছে নদী। বটগাছ, পুকুর, কচুগাছ, উঠোন, জবা গাছ, ঠাকুরঘর, আনন্দ এমন সব কথা। তারপর সেই কাগজগুলো একসাথে মিলিয়ে লটারির মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হল। যার কাছে যে লেখা গেছে এবারে তাকে সেটা অভিনয় করে প্রকাশ করতে হবে। সবাই করল। একদম শেষে যে চিরকুটটা তুলেছে সে কিছুতেই অভিনয় করতে চাইল না। কারণ জানতে চাওয়া হলে সে তার কাগজটা দেখাল, তাতে লেখা, মা। ও কেমন করে অভিনয় করবে! ও যখন খুব ছোটো তখন ওর মা মারা যান। ও কোনোদিন মায়ের আদর, মায়ের ভালবাসার মানে জানাতে পারেনি। বাড়িতে ঠাকুমার সাথে থাকে। বাবা দূরে কোথাও থাকেন চাকরি সূত্রে, বছরে একবার বাড়িতে আসেন।
দুপুরে স্নান খাওয়ার পর আবার কাজ শুরু হল। ‘বাড়ি কেন ভালো লাগে বা লাগে না’ এই নিয়ে তিনটে দল ভাগ করে নাটক তৈরি হল। তারপর বিকেলে সবাই মিলে মাঠে খেলা, সন্ধ্যেয় চা-বিস্কুট খেয়ে গানের ঘর আর যদি কোন দল নাটক তৈরি করতে পারে তো সে নাটকের অভিনয় দেখা। তারপর দেওয়াল পত্রিকা ‘কিচিরমিচির’-এর প্রস্তুতি নেওয়া বা আড্ডা দেওয়া বা খেলায় মেতে ওঠা।
তৃতীয় দিনের বিষয় ছিল ‘সমাজ’। সমাজ বলতে আমরা কী বুঝি, তার ভালো খারাপ দিক, একা থাকা আর সমাজের সকলের সাথে থাকা — এ সব নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক জমে উঠল। পুরো সময়টা এভাবেই কেটে গেল।
চতুর্থ দিন আমরা সবাই মিলে ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার দেখতে গেলাম। বিএসএফ ক্যাম্প ছাড়িয়ে একটু গেলেই কাঁটাতার। কাঁটাতারের ওপারে কিছুটা ভারতের জমি যেখানে চাষাবাদ হয়, তারপরে ইছামতী, ওপারে বাংলাদেশের জমি যেখানে চাষাবাদ হয় তারপর কাঁটাতার তারপর বাংলাদেশ। একজন বিএসএফ জোয়ান এসব বললেন আমাদের। আর একজন চাষি, তিনিও একই কথা বললেন। কাঁটাতারের ওদিকে ভারতের জমিতে এই চাষি কৃষিকাজ সেরে ফিরছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম নদীর পারে গিয়ে খুব কাছ থেকে বাংলাদেশ দেখব। কিন্তু নিয়মের বাধ্যতায় আমরা সে আশা থেকে বঞ্চিত হলাম।
আমি আগেই বলেছি, দেশ সমাজ পরিবার একটা নিয়মের মধ্যে আমাদের বেঁধে রাখতে চায়। এই নিয়ম ছেড়ে আমরা বেরুতে পারি না। হয়তো চাইও না। এই নিয়মের হাত ধরে ঘুরে এসে ‘দেশ’ নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলার পরেই নাটকের কাজ শুরু হয়ে গেল। বিকেলে নাটক দেখাতে হবে। শেষ দিন আসতে আর বেশি দেরি নেই, অনেক কাজ বাকি, নাটক তৈরি করার সময় কমে আসছে। বড়োরা এবারে শক্ত হাতে নাটক তৈরির কাজ শুরু করে দিলেন। খাওয়াদাওয়ার পরে নাটকের কাজ বিকেলে ‘যেমন খুশি সাজা’ তারপর গানের ঘর। আমরা সম্পূর্ণ নাটক প্রস্তুত করতে পারলাম না। ঠিক আছে, অর্ধেক নাটকই দেখানো যাক। তাই করা হল।
‘যেমন খুশি সাজা’য় বেশ মজা হল। চারটে দলই যৌথ ভাবে সাজল। স্কুলের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে মেতে উঠল সবাই। মনে হল যেন ছোটো ছোটো নাটক অভিনীত হচ্ছে। ললিপপরা করেছিল পাগলা গারদ, মহারাজেরা করেছিল শুটিং স্পট আর শ্রেষ্ঠ জুনিয়রেরা করেছিল আশ্রম।
পঞ্চমদিন সকালে ঘুরতে না গিয়ে ব্যায়াম করা হল। এগারোটায় হল ‘কাটুমকুটুম’ কুড়িয়ে আনা জিনিস দিয়ে। অসাধারণ হল। বাকি সময়টা নাটক তৈরির কাজ চলল।
ষষ্ঠদিন বার বার নাটক নিয়ে ঘষামাজা হল। আর বিকেলে দূরে একটা গ্রামে গিয়ে মহারাজ আর ললিপপদের নাটকদুটি অভিনীত হল। গ্রামবাসীদের জানানো হল, “কাল আমাদের মেলার শেষদিন। বিকেলে নাটক হবে গান হবে। আপনারা আসবেন।” এদিন সন্ধ্যেবেলায় শ্রেষ্ঠ জুনিয়র আর ক্যান্ডি-পরা নাটক দেখাল গানের ঘরে। সব প্রস্তুতি শেষ, এবারে শেষদিনের অপেক্ষা।
পরদিন শেষদিন। ঘরে ঘরে গান আর নাটকের মহড়া চলল। আর ওদিকে পলানদার সহযোগিতায় বটগাছের তলায় ক্যান্ডি-প আর অভিভাবকরা মাত্র তিন ঘণ্টায় একটা গোটা নাটক প্রস্তুত করে ফেললেন।
দুপুর তিনটে। ছোটো থেকে বড়ো সবাই দাঁড়িয়েছে লাইন করে। গান শুরু হল “মেলা মেলা শিশুমেলা আমাদেরই মেলা রে”, “আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা”, “ফুটবল খেলতেই হবে”। অনেক অভিভাবকেরা এসেছেন আজ। গ্রামবাসীরা এসেছেন ভিড় করে। তীর্থদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন। স্কুলের হেড মাস্টারমশাই কিছু কথা বললেন। এরপর ললিপপরা নাটক শুরু করল। তাদের দুটি নাটক। ‘কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি’ আর ‘গাছ’। এর মধ্যে ‘গাছ’ নাটকটার একটা বিশেষত্ব ছিল। নাটকটায় কোনো কথা বা সংলাপ ব্যবহার করা হয়নি। ছোট্ট ছোট্ট ওই বাচ্চাগুলো যারা সারাদিন কিচিরমিচির করে স্কুলবাড়ি কাঁপিয়ে রাখত তারা নিঃশব্দে গোটা নাটকটা করল কীভাবে !
শ্রেষ্ঠ জুনিয়রদের নাটক ‘দেশ মানে কি?’ আমরা বড়োরাও দেশ মানে কি বুঝি ? ওরা কিন্তু ওদের নাটকে স্পষ্ট করে বলল দেশ বলতে ওরা কী বোঝে।
এরপর আবার দুটো গান — ‘ও জোনাকি’ আর ‘ঝিনুক ঝিনুক রোদ উঠেছে কিনুক দেখি কেউ’। তারপর ক্যান্ডি-পদের ‘ঠাস’ আর মহারাজদের ‘পথের পাঁচালি’। ‘ঠাস’ খুব মজার নাটক। ‘পথের পাঁচালি’ ঠিক এর উল্টো অথচ অসামান্য সে নাটকও। শেষ নাটক ‘উদ্বাস্তু’। সব বড়োরা মিলেমিশে সমস্ত স্কুলবাড়িটা ব্যবহার করে করলেন। দারুণ।
অন্ধকার নেমে এল। সবার হাতে মোমবাতি জ্বলছে। চোখে জল আর কণ্ঠে “আগুনের পরশমণি”। বিদায়ের সুর। ঘরে ফেরার পালা। সাতদিনের সুখ দুঃখ, ঝগড়া, একসাথে থাকা, ভালোবাসা — সবকিছুর শেষ। আবার সামনের বছরের জন্য অপেক্ষা।
আমি যখন থিয়েটার করতে শুরু করি তখন থিয়েটারের কিছুই জানা ছিল না। জানার ইচ্ছেও ছিল না। থিয়েটারের দর্শন কী বস্তু জানি না। আমি পুরো ফাঁকা ছিলাম। তারপর যত দিন গেছে একটু একটু করে শিখেছি। আমার ফাঁকা জায়গাটা ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠছে। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই পূর্ণ হওয়ার খেলা চলবে। শেখার শেষ নেই — আমি বিশ্বাস করি।
আমি পাঁচ বছর ধরে শিশুমেলায় যাচ্ছি। কিছু উপলব্ধি হয়েছে। একদম শুরুতে যে বড়োরা এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের একটা নির্দিষ্ট দর্শন ছিল। একটা সুপরিকল্পিত ভাবনা ছিল। যারা নাটক করেন তাঁরা যদি সাতদিন টানা একসাথে থাকতে পারেন তবে ছোটোদের মধ্যে কিছু সচেতনতা তৈরি হবে। নাটক করার সক্ষমতা বাড়বে। তাদের সুপ্ত প্রতিভাগুলো প্রকাশিত হবে। একসাথে থাকার একটা অভিজ্ঞতা হবে। নিজের কাজ নিজে করলে যে আনন্দ সেটা অনুভব করতে পারবে — এমন অনেক কিছু যা ছোটোরা বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে পারে না।
যারা এমন ভাবে ভেবেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই শিশু-মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞ বা শিশুনাট্য বিশেষজ্ঞ। ছোটোদের কাজ কীভাবে করা যায় সে ব্যাপারে তাঁরা তো এ রাজ্যে পথিকৃৎ।
কিন্তু এই বড়োদের সংখ্যা কমে আসছে। যারা এতদিন ছোটো ছিল তারা বড়ো হয়েছে। তাদের দায়িত্ব বেড়েছে। এখন তারাও ছোটোদের ঘরে কাজ করানোর দায়িত্ব পাচ্ছে। কিন্তু তারা কি পারছে? খটকা লাগছে।
একদিনের ঘটনা বলি। একটি দৃশ্যের মহড়া চলছে। তিনজন ভিক্ষুক। রাত। একজনের ঘুম আসছে না। পুরোনো কিছু ভয় তাকে তাড়া করছে। যখন কাজ হচ্ছিল তখন ওই ভিক্ষুকের চরিত্রের অভিনেতা ছোট্ট ছেলেটি সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন তাকে ডেকে তুলে এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়াল দৌড় করানো শুরু হল। একবার সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল তবুও তাকে দৌড়োতে বাধ্য করা হল যাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। আমি খুব আহত হয়েছিলাম। ঐ ছোট্টটি যখন বড়ো হবে, ছোটোদের সঙ্গে কাজ করবে, তখন সেও ছোটোদের সঙ্গে এমন আচরণই করে ফেলবে না তো ? দীর্ঘ আঠারো বছরের শ্রমে গড়ে ওঠা যে বিশ্বাস বড়োরা রেখেছিলেন তার প্রতি কি সুবিচার করা গেল ?
প্রত্যেকবার একেবারে শুরুতে বলা হয় ছোটোদের ওপর কোনো জোর করা চলবে না। ছোটোদের মধ্যে থেকে যেটা উঠে আসবে সেটাই শেষদিন দেখানো হবে। এবারও হল না সেটা। প্রায় প্রতিটা নাটকেই চাপ দিয়ে ফেলা হয়, যাতে ওই নাটকটাই শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে। সবাই বাহবা দেবে — এই ভাবনা থেকে ছেলেমেয়েদের ওপর চাপ দিয়ে ফেলা হয়। এবারে একজন শিশু বাড়ি ফিরে গিয়ে অভিযোগ করেছিল যে তাদের ঘরে নাটক করানোর সময় খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন মাস্টার বড়োরা। কেউ কিছু একটা না পারলে বলা হয়েছে — “ও পারলে তুমি পারবে না কেন?” বাধ্য করা হয় কাজটা করতে। ওরা নাকি একদিন দুপুরে স্নান করতে পারেনি নাটক তৈরি করার চাপে। এমনকী শেষদিন অনেক বেলা পর্যন্ত অবিরত রিহার্সাল করানো হয়েছে। ঐ ছোট্টটির কথায় নাটক তৈরির সময় তাদের কোনো মতামতই গ্রহণ করা হয়নি। নাটকের গল্প, কোরিওগ্রাফি, সাজ পোশাক সব ঠিক করে দিয়েছিলেন মাস্টার বড়োরা। নাটকটা ‘চমৎকার’ হয়েছিল। সকলে বাহবা দিয়েছিলেন। সত্যি সাতদিনে এমন চমৎকার ফিনিসড নাটক! কিন্তু ছোটোদের অনেক অভিযোগ তৈরি হল। তাদের ‘বিকাশ’-এর কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হল না কি? এটা কেন? তাতে কি আঠারো বছরের শ্রম ব্যর্থ হল না?
এই মেলায় খরচ বাবদ ছোটোদের কাছ থেকে ২৫০ টাকা আর বড়োদের থেকে ৪৫০ টাকা নেওয়া হয়। অবশ্য এটা বাধ্যতামূলক নয়। কেউ যদি না দিতে পারেন না দেবেন। সাতদিনে ২৫০ টাকা বা ৪৫০ টাকাটা খুবই কম। তারই মধ্যে ফ্রায়েড রাইস, মাংস বা বিরিয়ানির মতো ব্যয় সাপেক্ষ খাবার না দিয়ে যদি ডাল ভাত তরকারিকেই সুন্দর করে আকর্ষণীয় করে দেওয়া যায় যাতে দেখেই লোভ হয়, যেমন তরকারির ওপর ডেকোরেশন বা গরম ভাতের সঙ্গে ঘি সঙ্গে ভাজা। একটু অন্যরকম আর কি। তাতে সয়াবিন আর ডাল-আলু সেদ্ধ খেয়ে খেয়ে ছোটোরা যে হাঁপিয়ে ওঠে, যে একঘেয়েমিতে ভোগে তা এতে কাটতে পারে। ফলে শেষদিনে যদি কোনো মুখরোচক খাবারের দোকানি ঢুকে পড়েন তবুও ছোটোরা হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ে হ্যাংলামো করবে না, আর বেচারা দোকানিকে স্কুলের বাইরে বের হয়ে যেতে বলার মতো আপত্তিকর এবং অপমানজনক অবস্থা সৃষ্টি হবে না।
কাজ করলেই তার সমালোচনা হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমার বলার যেটা — শিশুমেলা দীর্ঘজীবী হোক। এত কিছু বলার পরেও বলছি শিশুমেলার ছোটোরা আর পাঁচটা শিশুর থেকে অন্যরকম হয়। এটা খুবই সত্যি। অনেক ছোটো থেকেই তারা একটু একটু করে সমাজ সচেতন হয়ে ওঠে।
শিশুমেলা আরও বর্ণময় হয়ে উঠুক।
জয় হোক শিশুমেলার।
Leave a Reply