নিত্যানন্দ জয়রামনের ফেসবুক প্রকাশনা থেকে, অনুবাদ ও সম্পাদনা শমীক সরকার, ১৩ ডিসেম্বর#
চেন্নাই-এর বেসান্ত নগর সমুদ্র সৈকতে ‘স্পেস’ বা ‘পরিসর’-এ রবিবার (১৩ ডিসেম্বর) একটা আলোচনায় জড়ো হয়েছিল শ’দেড়েক মানুষ, যাদের মধ্যে একশ’ জন অল্পবয়সী, আর জনা পঞ্চাশেক বেশি বয়সী। এনারা সবাই চেন্নাই বন্যায় কমবেশি ত্রাণকার্যে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন এবং চেন্নাই বন্যার শিক্ষা কী, তা নিয়ে কথাবার্তা বলতেই এই জড়ো হওয়া। এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল — ‘ত্রাণ এবং পুনর্বাসন ছাড়িয়ে : চেন্নাই পুনরাধিকার, গণতন্ত্র পুনরাধিকার’। ঠিক হলো, তারাহুড়ো করে সংগঠিত হয়েছে, তাই লোকজন কম এসেছে, কিন্তু পরের মাসে চেন্নাইতে একটা মিছিল বা মানব শৃঙ্খল রচনা করা হবে বড়ো করে। যাতে সরকারের টনক নড়ানো যায়। যাতে প্রশাসনের দায়বদ্ধতার বন্দোবস্ত করা যায়।
শুরুতেই সাত্ত্বিক গাদে শুরু করলেন একটি কুইজ দিয়ে, লোকে চেন্নাই সম্পর্কে কী জানে, তার জলাশয়গুলি সম্পর্কে, স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কে কী জানে। সাত্ত্বিক গাদেকে বলা হয় তামিলনাড়ুর জল-মানব, তিনি জানালেন বৃষ্টিপাত কী, এবং জানালেন, কীভাবে স্যাটেলাইট এবং ডপলার রাডার-এর ছবি দেখে বোঝা যায় ব্যাপারস্যাপারগুলো। তিনি বোঝালেন, কীভাবে ১ ডিসেম্বরের ডপলার ছবি দেখেই সাধারণ ধারনাগুলি দিয়ে বলে দেওয়া যেত, জলধারণকারী মেঘ (১৮ কিমি গভীরতার) নড়ছেই না চেন্নাই-এর ওপর থেকে, বিপদ আসন্ন। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর কিন্তু কোনো সতর্কতা জারী করেনি। দৈনিক ডপলার ছবি দেখা যায় এই ঠিকানায় http://www.imd.gov.in/section/dwr/dynamic/dwr.htm
তিনি বললেন, কোনো উড়ো কথা বিশ্বাস করার আগে সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করা প্রয়োজন। তাতে গুজব রটনাকারীদের হাত থেকে বাঁচা যায়। ত্রাস সৃষ্টিকারীদের হাত থেকে বাঁচা যায়। নিশ্চিত না হয়ে আশু বিপদের টুইট ফরোয়ার্ড না করাই ভালো।
টি আর শাশ্বথ দেখালেন, কীভাবে বৃষ্টিপাত বন্যা ডেকে এনেছে। গত ১০০ বছরের চেন্নাই-এর মানচিত্র দেখিয়ে, এবং কীভাবে জলাশয়গুলো এবং নিকাশী নালাগুলো উধাও হয়ে গেছে।
শ্রুতিসাগর ইয়ামুনান ব্যাখ্যা করলেন, কীভাবে মূলধারার সংবাদমাধ্যম নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে এবং সামাজিক গণমাধ্যম শুধু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে নয়, ত্রাণকার্যেও বড়ো ভূমিকা নিচ্ছে।
এস এইচ মোহামেদ আরশাদ জানালেন, কীভাবে সরকারের তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষ ত্রাণ ও উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে। তিনি বললেন, কমবয়সীদের রাজনীতিতে নামা উচিত, এবং শহরটার দখল নেওয়া উচিত।
অশ্বিন ছাবরিয়া, কমার্স গ্রাজুয়েট, জানালেন কীভাবে সামাজিক গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেট ফোনের অ্যাপের মাধ্যমে ত্রাণ ও উদ্ধারকার্য কো-অর্ডিনেটেড হয়েছে, যখন মাঠে ময়দানে সরকারি কো-অর্ডিনেশন অনুপস্থিত। অশ্বিন আবেদন জানালেন, সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করা দরকার দায়িত্ববোধের সঙ্গে, এবং তাকে গুজব ছড়ানোর আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেওয়া উচিত নয়।
বারাথি কান্নান, লয়লা কলেজের এম ফিল ছাত্র এবং তাম্বরমের বাসিন্দা দেখালেন, সরকারের পদক্ষেপগুলো কী কী এবং সেগুলোর দুর্বলতা কোথায় কোথায়। তিনি স্থানীয় স্তরে কাউন্সিলর ও পার্টির লোকেদের গুণ্ডামির কথা শোনালেন। এবং ত্রাণকার্যে তারা বাধা সৃষ্টি করার সময় পুলিশ যে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তাও জানালেন।
এরপর সবাইকে বলতে আহ্বান জানানো হয়। অনধিক তিন মিনিট সময় নিয়ে বিভিন্ন বয়সী সাতাশজন মানুষ বক্তব্য রাখেন। রামা সুব্রামানিয়াম সংক্ষেপে ত্রাণ ও উদ্ধারকার্যে স্বেচ্ছাসেবীদের (কমবয়সী ও বেশিবয়সী) কিছু কিছু অভাব অভিযোগ ও মতামত তুলে ধরেন :
“আমাদের ছেলেমেয়েদের সম্পত্তি ও টাকাপয়সা দেওয়ার চেয়ে বরং আমরা প্রতিবাদ, আন্দোলন, এবং সমাজকর্মের ঐতিহ্য দিয়ে যাই”;
“প্রশাসনিক কাজের ভারও মানুষের নিজের হাতে তুলে নেওয়া দরকার। যদি বন্যার সময় যখন ব্যবস্থাটি ফেল করে গেছে, তখন আমরা এতকিছু করতে পারি, তাহলে প্রশাসনিক কাজও আমরাই করে নিতে পারবো না কেন?”;
“আমাদের এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এখানকার মৎস্যজীবীরা। যখন সবাই ব্যর্থ, তখন ওরা অনেক প্রাণ ও সম্পদ বাঁচিয়েছে।”
“এই শহরটা তো আসলে মৎস্যজীবীদেরই।”
“মুসলিমদের অংশগ্রহণই সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। সবগুলি মসজিদ তাদের দরজা খুলে দিয়েছে দুর্গতদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য।”
“আমার একটা অপরাধবোধ কাজ করছে, আমি এবং আমাদের মতো লোকেরা, যারা এই বন্যায় সেভাবে পীড়িত হইনি, তারা কীভাবে শতসহস্র পীড়িতদের সঙ্গে কথা বলবো।”
“আমার মধ্যে একটা বদল ঘটে গেছে, এখন আমি ট্যাপকল খুললেই ভাবি, ওই চারদিন এক ফোঁটা জলের কী মূল্যই না ছিল। যদি আমরা ওই ক’দিন অন্ধকারে লন্ঠন জ্বালিয়ে থাকতে পারি, বহির্দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ছাড়াই এবং কেবল পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, তবে মাঝে মাঝেই এইরকম করা যেতে পারে।
এছাড়া বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে উঠে আসে, বর্জ্য পৃথকীকরণের গুরুত্বের কথা, যেখানে সেখানে বর্জ্য না ফেলা, বিদ্যুৎ-জল এবং জিনিসপত্র ব্যবহারে সচেতন হওয়া, ঘর এমনভাবে বানানো যাতে সেখানে নিকাশী ব্যবস্থা এবং গাছপালা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে।
আরো উঠে আসে, উজ্জ্বল, সৎ এবং সাহসী কমবয়সীদের রাজনীতি থেকে বিচারব্যবস্থা — সব জায়গায় নিয়ে আসা দরকার, যা ব্যবস্থার মধ্যের গলাপচা ব্যাপারটিকে সংস্কার করতে পারবে।
এই সভাটি যারা সংগঠিত করেছিলেন, তাদের মধ্যে নিত্যানন্দ জয়রামন জানালেন, এই মিটিংটি কিন্তু কোনো গোষ্ঠী তৈরি করার জন্য নয়, বরং এটি একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বহু গোষ্ঠী তৈরি হতে পারবে এবং কাজ করতে পারবে একটি সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে। বন্ধুত্ব, বিশ্বাস এবং সাধারণ উদ্দেশ্য — এগুলোই হবে ওই গোষ্ঠীগুলির ভিত্তি। প্রসঙ্গত, এই মিটিংটির আহ্বান জানাতে গিয়ে ফেসবুকে সংগঠকরা লিখেছিলেন, “কেবল পঁয়ত্রিশ বছরের চেয়ে কম বয়স যাদের, তারাই বক্তব্য রাখতে পারবেন”।
সভাশেষে ঠিক হয়, ফেসবুকে ‘রিক্লেমিং চেন্নাই’ অর্থাৎ ‘চেন্নাই পুনরাধিকার’ নামে একটি আলোচনার ফোরাম খোলা হবে। যারা এই মিটিং-এ এসেছেন, তারা সবাই তাতে থাকবেন। অন্যরাও আস্তে আস্তে যোগ দেবেন। সেই ফোরামে সদস্যরা নিজেদের, আইডিয়া, একসাথে কাজের পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম তুলে ধরতে পারবেন।
Leave a Reply