বাউল ফকির সঙ্ঘ (রেজিঃ নং- এস/৪৬১০২)-র তেত্রিশতম সম্মেলন (স্থানঃ মালেক ভরসার আশ্রম, দুর্লভের পাড়া, জলঙ্গী, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ), ১৯-২০ শে ডিসেম্বর ২০১৫ এ সম্পাদকের ভাষণ#
শ্রদ্ধেয় সভাপতি ও সমবেত সাধুমন্ডলী,
আজ ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ আমরা বাউল ফকিররা মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানার চোঁয়াপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত দুর্লভের পাড়ার মালেক ভরসার আশ্রমে মিলিত হয়েছি; উদযাপন করছি বাউল ফকির সঙ্ঘের তেত্রিশতম বাউল ফকির সম্মেলন। ১৯৮৪ সালের ১২ ই মার্চ শুরু হয় আমাদের সূচনা সম্মেলন। তারপর থেকে প্রতিবছর নদীয়া-মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তরে এইভাবে মিলনমেলায় মিলিত হয়ে সম্মেলন উদযাপন করে চলেছি।
যারা জাত পাত মানেন না, সবার উপরে মানুষকে স্থান দিয়ে মানুষেরই সেবা পূজা করেন, এই মানুষেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে মুর্শিদাবাদ নদীয়া জেলাসহ বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতেন- এটা আমরা দেখতাম। আর মানুষকে সেবা পূজা করা, প্রচলিত ধর্মাচারের বাহ্যিক আড়ম্বর না মানার অপরাধে দুর্বৃত্ত ধর্মান্ধরা অত্যাচার চালাত বাউল ফকিরদের উপর। অশেষ লাঞ্ছনা সহ্য করে এমতবাদ পালন করতে হত তাদের। এ অত্যাচার কেউ জানতে পারতনা। আমরা শক্তিনাথ ঝা মহাশয়ের লেখা থেকে বিভিন্ন জায়গার অত্যাচারের ঘটনাগুলি জানতে পারি। বিভিন্ন জায়গার বিচ্ছিন্ন বাউল ফকির গোষ্ঠীকে একত্রিত করা এবং অত্যাচারের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের প্রবল আগ্রহে এবং শক্তিনাথ ঝা মহাশয়ের সহায়তায় ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে রেজিস্ট্রিকৃত হয় বাউল ফকির সঙ্ঘ।
১৯৮৩ সাল থেকে আমরা সাংগঠনিক ভাবে অজস্র অত্যাচারের ঘটনার প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেছি। পাশাপাশি বাউলচর্যা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরতে থাকি। আমাদের সাধক গায়কেরা যথার্থ বাউল শিল্পীর মর্যাদা পেতে থাকে। আমাদের চেষ্টায় বহু শিল্পী আকাশবাণী মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে গান করার সুযোগ পায়। আমরা এসময়ে বাউল চিকিৎসার মূল্যবান উপাদানগুলি সংগ্রহ করি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্পে। আমরা নওদা থানার ভোলানগরের পীরগোবিন্দ তলায় পাঁচ বিঘা জমি পেয়েছিলাম। সেখানে বাউল চিকিৎসার প্রয়োজনীয় গাছগাছড়া গুলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট স্বেচ্ছামূলক শ্রমদাতার অভাবে আমরা তা করতে পারিনি। সংগঠনের সহায়তায় বাউল, বাউলতত্ত্ব, চর্যা ও সাধনা নিয়ে ‘বস্তুবাদী বাউল’ এবং বাউলদের নিপীড়নের তথ্য নিয়ে বাউল ধ্বংসের আন্দোলনের ইতিবৃত্ত (সুবর্ণরেখায়) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও দুই শতাধিক জীবিত ও মৃত মহাজনদের দু’হাজার পদাবলী সংগ্রহ ও সংকলনে আমরা শক্তিনাথ ঝা কে সাহায্য করেছি।
বাউল ধ্বংসের, আন্দোলনের ইতিবৃত্তে বিশেষ করে বাউল ফকিরদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস বিদ্যমান। সেখানে রয়েছে মন্টু খাঁ, গোলাম মুর্তজাদের নেতৃত্বে বাউল ফকির বিরোধী অত্যাচার শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ এ নদীয়া-মুর্শিদাবাদে। তাতে নওদা হরিহরপাড়ায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। D.I. Rule এ GR.No-126/73 এ পুলিশ প্রশাসন ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। হরিহরপাড়ার হরিশপুরে অত্যাচারীরা গ্রেপ্তার হয়। এসময়ে এনায়েতুল্লা বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, এম. পি. খোদাবক্স বাউল-ফকিরদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হরিশপুরের আলিবক্স সাক্ষী আছেন। এনায়েতুল্লা বিশ্বাস আমাদের বাউল ফকির সঙ্ঘে ছিলেননা। কিন্তু স্বরূপপুরের বসিরউদ্দিন শা এর বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাধুসভায় যে আমাদের প্রথম সম্মেলন হয়, সেখানে এনায়েতুল্লা বিশ্বাসের উপস্থিতিতে হরিহরপাড়া থানার ভবানীপুরে তার শিষ্যগণ তাদের উপর অত্যাচারের কথা বলেন। আমি এবং শক্তিনাথ ঝা সশরীরে সেখানে যাই। সশস্ত্র ধর্মান্ধেরা আমাদের ঘিরে ধরে। সে অনেক কথা…
ইদানীং হরিহরপাড়ার কেউ ১৯৭৩ এর আন্দলনে এনায়েতের দলে তার কৃতিত্ত্বের কথা প্রচার করেছে। এ প্রচার সর্বৈব মিথ্যে। বাউল ফকির নিপীড়নে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমি এবং আর দু’চারজন শক্তিনাথ ঝা এর সাথে সর্বত্র গিয়েছি। এখানে সোমপাড়ার লোকেরা আছেন, তারা এ তথ্য জানেন। সামান্য আগে বাঁশবাড়িয়ার অত্যাচারিত লোকেরা আছেন। তারা জানান কারা বাস্তবে অত্যাচারের সময় থাকেন। নানা মিথ্যা প্রচার করে নিজেকে বড় করে। বাউল ফকিরদের নিপীড়নকে বিকৃত করার থেকে বিরত হউন।
আমাদের সংগঠনকে যারা ভেতর থেকে ভাঙতে চান তারা অর্থনৈতিক কুৎসা করেন। ১৯৮৪ সালে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর এক হাজার টাকা মাত্র অনুদান দিয়েছিল। কিন্তু কুৎসাকারীরা রটিয়ে দেয় বাউল ফকির সঙ্ঘ এক লাখ টাকা পেয়েছে এবং সমস্ত টাকা শক্তিনাথ ঝা, আকবর আত্মসাৎ করেছে। সংস্কৃতি বিভাগের অনুদান অনুমোদনের পত্রে টাকাটি কথায় লেখা ছিল বলে বহু জায়গায় সে পত্র দেখিয়ে কুৎসা থেকে মুক্ত হই। এরপরে আমরা সংগঠন বা সম্মেলনের জন্য কোনো সরকারি অনুদান চাইনা এবং পাইনা। সদস্যদের দেয় চাঁদার টাকায় সংগঠন চলে এবং প্রতিবছর বৈধ হিসাব পরীক্ষক দিয়ে হিসাব অডিট করা হয়।
আমাদের সমস্ত প্রচারপত্রগুলি অত্যন্ত পরিশ্রম করে শক্তিনাথ ঝা লেখেন। আমরা সম্মতি দিয়ে সাক্ষর করি। কিন্তু হালে লিখতে কলম ভাঙে। এমন কেউ এগুলি অযৌক্তিক সমালোচনা করে এবং কৃতিত্ব দাবী করে এবং শক্তিনাথ ঝা যেন সংগঠন ছেড়ে দেন এমন কাজ করেন। তিনি সংগঠন ছেড়ে দিলে সংগঠন দুর্বল হবে এবং ধর্মান্ধেরা নির্বিবাদে শুরু করবে অত্যাচার। সুতরাং এ কুৎসাকারীরা অসাধক মৌলবাদেরই অনুচর। সংগঠন বিরোধী এ গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে সকলে সজাগ থাকুন।
আরো জানাই যে, মৌলবাদের অনুচরেরা হিন্দু এবং মুসলমান সাধকদের বাউল এবং ফকির অথবা মারফতি নামে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। বৃহস্পতিবার বা সাধুসভায় মদ-মাংস খাওয়ায় তারা প্ররোচনা দেয়। সংগঠনের নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব ও কর্মীদের তারা বাউল ফকির থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাদের দুর্বল করতে চায়। এবং মৌলবাদের পতাকা ওড়াতে চায় সর্বত্র। এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে বাউলগণ সজাগ থাকুন।
একদিকে নেশায় প্ররোচনা, এরই পাশাপাশি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আমরা নানা কিসিমের নেশার বিরোধিতা করে চলেছি। এখনকার গ্রামবাংলার নানা ধরনের নেশা গ্রামজীবনকে গ্রাস করছে। বিশেষ করে মুসলিম গ্রামগুলিতে নেশার ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। বাউল ফকির সঙ্ঘ মহাজনদের গান সংগ্রহ করে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার ভিত্তিতে নেশা বিরোধী সি. ডি. প্রকাশ করেছে। আমরা বহু অনুষ্ঠানে এবং সম্মেলনে ধর্মের নামে নেশার প্রতিবাদ করে চলেছি।
আমরা আরো জানাই যে, আমরা স্বল্পে, সহজ জীবনযাপনে সুখশান্তি সন্ধান করি, কেননা ধনৈশ্বর্য সুখশান্তি দেয়না। এই জীবনযাপনের পাশাপাশি সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ধর্মান্ধদের অত্যাচার প্রতিরোধ করি। বাউলচর্যার ঐতিহ্যগুলি সংগ্রহ করে বাউল ফকিরদের ফিরিয়ে দিই। নানা চিত্র-পরিচালক এবং গায়কদের নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করি। শিল্পীদের মহাজনদের পদ সংগ্রহ করে দিই এবং গানের সুর সংগ্রহ করতে সাহায্য করি। সাধকদের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার দরজা খুলে দিই।
আমরা বাউলচর্যার পথে আছি এবং থাকব। আর এপথের পথিকদের ঐক্যবদ্ধ করে এক সুখ শান্তির সমাজ গড়ার মিছিলে হেঁটে চলব বহুকাল। তাই জানাতে চাই যে, ভারতবর্ষ সমন্বয়ের দেশ। এখানে একটি ধর্মসম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে ধ্বংস বা বিলুপ্ত করেনি। নানা বৈচিত্রকে সকলে স্বীকার করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করি আমরা। দেশবিভাগের পর থেকেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং বিদ্বেষ এদেশের মানুষকে রক্তাক্ত করছে। সাধারণ মানুষ দলাদলি পছন্দ করেনা। আমরা বাউল ফকিরেরা কেউ বলি, ‘যতক কাল্লা ততক আল্লা’। তাই অন্যের ভিন্ন খাদ্য, আচারের প্রতি সহনশীলতা এদেশের এক সামাজিক কর্তব্য। এদেশের হিন্দুদের একাংশের মাংস ছাড়া আহার হয়না। অন্য অংশ মাংসের ছোঁয়া খায়না। ভারতীয় মুসলমানদের প্রায় অর্ধাংশ গোমাংস খায়না। এই বৈচিত্র এবং সহনশীলতা ভারতবর্ষের অন্য নাম। আমরা বাউল ফকিরেরা মানুষকে মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ডাক দিই।
আকবর আলি সেখ
সেক্রেটারি, বাউল ফকির সঙ্ঘ
arvind anjum says
dhanyawad