শমীক সরকার
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩
ক্ষমতার খেলাঘর শক্তিশালী গণমাধ্যমের বিপরীতে ইন্টারনেট যে একটা খুবই শক্তিশালী সামাজিক মাধ্যম, তা বেশ কয়েকবছর আগেই বোঝা গেছিল। ইন্টারনেট সামাজিক কথোপকথনের একটা জায়গা, নিজের কথা অন্যের কাছে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত। এবং এই পরিসরে বাস্তব সমাজে মাতব্বর যারা, তাদের মাতব্বরি তুলনায় কম। কোনো এক সাধারণ মানুষও তার কথাটা একটু গুছিয়ে যদি বলতে পারেন, তাহলে শ্রোতা পাওয়া যাবে। বড়ো মিডিয়া — টিভি বা দৈনিক সংবাদপত্র বা বড়ো ম্যাগাজিনে যুগ যুগ ধরে যেভাবে তালেবড়, মাতব্বর আর পারদর্শীদের কথাই শোনা যায়, ইন্টারনেট তার থেকে আলাদা। কেউ পারদর্শী বা মাতব্বর বা এমনকী খুব সঠিক না হয়েও তার কথা প্রকাশ করতে পারে ইন্টারনেটে। টিভি, রেডিও বা সংবাদপত্রে একবার একটা কথা প্রকাশ পেলে তার ক্ষমতা অনেক বেশি। কারণ একটি প্রোগ্রাম লক্ষ লক্ষ লোক দেখা বা শোনার রেডিমেড বন্দোবস্ত সেখানে থাকে। আপনি চান বা না চান, সেটা আপনি দেখতে/শুনতে বাধ্য। যেমন, আপনি যদি চান, দৈনিক সংবাদপত্রে ধোনির কেরামতি নিয়ে লেখা পড়বেন না, মনমোহনের কথা শুনবেন না বা মমতার মুখ দেখবেন না, তাহলে কি পারবেন? পারবেন না। টিভি খুললে বা দৈনিকের পাতা খুললেই তারা হাজির। ইন্টারনেট তার তুলনায় অনেক গণতান্ত্রিক। আপনি না চাইলে এসব নাও দেখতে পারেন। সেখানে একই জিনিস লক্ষ লক্ষ লোক দেখতে বাধ্য তো নয়ই, দেখেও না। তাই সেদিক দিয়ে দেখলে ইন্টারনেটের ক্ষমতা অন্যান্য মিডিয়ার তুলনায় অনেক কম। আর তাই সে সুন্দর। মাতব্বরি, তালেবরি বা পারদর্শিতাকে হাজার হাজার লোক ধন্য ধন্য করবে — এর জন্য ইন্টারনেট নয়। অন্তত ইন্টারনেটের মৌলিক ডিজাইনের মধ্যে তা নেই। এটা বড়ো পরিসর, অর্থাৎ ক্ষমতার পরিসর নয়। ছোটো পরিসর, অর্থাৎ সামাজিক পরিসর। আর তাই ইন্টারনেট নিঃসন্দেহে ক্ষমতামুক্ত সমাজের পথে যাত্রার পাথেয়। বলাই বাহুল্য, ওই পথে পরিত্যাজ্য বড়ো মিডিয়া — টিভি, বড়ো দৈনিক …।
এই কথাগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দিল বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন।
মাতৃভাষায় ইন্টারনেট
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের প্রসার শুরু নেট-এ বাংলা ভাষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে। ইন্টারনেট ইংরেজিতে তৈরি। কম্পিউটারও তো ইংরেজিতেই তৈরি। কিন্তু কম্পিউটারে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল, কারণ তা নাহলে তো সেটা কেবল ইংরেজি দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে! বিভিন্ন ভাষাকে ‘কম্পিউটিং’-এ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সেই প্রচেষ্টারই অঙ্গ হিসেবে প্রতিটি ভাষার লিপি সম্বলিত একটি সম্মিলিত লিপিমালা তৈরি শুরু হয়েছিল। সেই প্রয়াসেই ‘ইউনিকোড’ নামে একটি স্ট্যান্ডার্ড-এর প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৯১ সালে (ইউনিকোড কনসর্টিয়াম নামে একটি অলাভজনক সংস্থার মাধ্যমে)। সেই প্রথম ভার্সানেই অন্য আরও তেইশটি ভাষার লিপির সঙ্গে বাংলাও ছিল। এখন ইউনিকোডে মোট ১০০টি ভাষার লিপি এসেছে। এই সম্মিলিত লিপিমালার স্ট্যান্ডার্ডের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি ভাষার প্রতিটি লিপির প্রতিটি পৃথক বর্ণ এবং সংযোজনী (যেমন বাংলায় আ-কার, উ-কার প্রভৃতি)-র জন্য পৃথক পৃথক ‘কোড’ থাকবে। যেমন বাংলার জন্য ধরা আছে আছে ১৪৪টি কোড, যার মধ্যে ১০৮টি কোডে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণগুলি, স্বরবর্ণগুলি, সংযোজনীগুলি এবং সংখ্যাগুলির (০-৯) জন্য নির্দিষ্ট করা আছে, বাকিগুলো এখনও ফাঁকা। যুক্তবর্ণগুলির জন্য কোনো কোড রাখা নেই। একাধিক কোডকে একটু কায়দা করে ব্যবহার করার মাধ্যমেই যুক্তবর্ণ বানিয়ে ফেলা যায়। কি-বোর্ড লে-আউট যারা বানায়, তারা এই ব্যবহার জানে। এরপরের কেরামতিটা ফন্ট-এর, যারা ফন্ট বানায়, তাদের। উদাহরণ, ইউনিকোডে ‘ক’, বিরাম সংযোজনী ‘্’ এবং ‘ষ’-র জন্য আলাদা কোড আছে। এই তিনটি পরপর কি-বোর্ড দিয়ে টেনে আনলে ‘ক্ষ’ তৈরি হয়। কিন্তু এই ‘ক্ষ’-টা তখনই দেখাবে, যদি যে ফন্ট ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে ‘ক্ষ’ অক্ষরের ছবিটা থাকে এবং বলা থাকে যে কি-বোর্ডে এই তিনটি পরপর চাপলে এই ছবিটি আসবে। সেজন্য চাই ইউনিকোড মেনে চলা কি-বোর্ড এবং ইউনিকোড মেনে চলা ফন্ট।
‘ইউনিকোড’ ছাড়াও এরকম লিপির স্ট্যান্ডার্ড আরও কিছু আছে, যেমন অ্যাসকি, বিভিন্ন আইএসও। কিন্তু সেগুলোতে প্রতিটি ভাষার প্রতিটি লিপির প্রতিটি বর্ণের জন্য আলাদা করে কোড রাখার সার্বজনীন ভাবনা নেই। ফলে আপাতভাবে কাজ চলে গেলেও, তা ইন্টারনেটের দুনিয়াতে — যেখানে সব ভাষার মানুষ ব্যবহারকারী, সেখানে অচল। বলে রাখা ভালো, পেজমেকার বা অ্যাডোব-এর সফ্টওয়ারগুলি, যেগুলিতে বাংলা প্রেসের কাজ হয়, তা সে এপার বাংলা বা ওপার বাংলা যেখানেই হোক — সেইসব সফ্টওয়ারগুলি মূলত ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলে না। প্রথমদিকে মাইক্রোসফ্টও ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ড মানত না। কিন্তু আস্তে আস্তে সুরসুর করে এইসব সফ্টওয়ার দৈত্যগুলিও ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ড মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
‘ইউনিকোড’ স্ট্যান্ডার্ডে বাংলার পুরোদস্তুর উন্নতি হতে সময় লেগেছিল। ৎ, রেফ্ প্রভৃতির জন্য কোনো কোড ছিল না। তার কারণ, বাংলাভাষীদের তা নিয়ে খুব একটা গরজ ছিল না। বাংলাভাষার প্রেসের কাজ অন্যান্য স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে দিব্বি চলে যাচ্ছিল। আরেকটা সমস্যা ছিল ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ডের কি-বোর্ড এবং ফন্ট। আগে অ্যাসকি স্ট্যান্ডার্ডের কিছু বাংলা কি-বোর্ড লেআউট এবং ফন্ট ছিল। সেগুলো দেখতে বেশ ভালো। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বড়ো ছোটো প্রেসের কাজ সেসব দিয়েই চলত। কিন্তু প্রথমত, সেগুলি সবই ছিল বাণিজ্যিক। এবং সেগুলি মুক্ত সফ্টওয়ার তো নয়ই। তার ওপর সেগুলো ইন্টারনেটে ব্যবহারযোগ্যও নয়। ইন্টারনেটে বাংলার বিস্তার না হলে বাংলা টাইপিং কিন্তু প্রফেশনালদের কাজ হয়েই থেকে যেত। সাধারণের জিনিস হয়ে উঠত না।
২০০১ সাল নাগাদ এক সাথে অনেকগুলি ঘটনা ঘটার জন্য ইন্টারনেটে বাংলা বিস্তারের ক্ষেত্র খুলে যায়। প্রথমত, বাংলাভাষীদের মধ্যে প্রায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিয়ে ব্যবহার হওয়া অপারেটিং সিস্টেম মাইক্রোসফ্ট উইন্ডো-র এক্সপি সার্ভিস প্যাক-২ ভার্সানে বাংলা স্ক্রিপ্ট আসে, অর্থাৎ তা ইউনিকোডের পূর্ণাঙ্গ স্ট্যান্ডার্ড মেনে নেয়। এবং সঙ্গে একটা ফ্রি ইউনিকোড বাংলা ফন্টও দেয়, বিচ্ছিরি দেখতে, নাম বৃন্দা। ওই ২০০১ সালেই বাংলাদেশের একটি কি-বোর্ড লেআউট ও ফন্টের কোম্পানি ‘একুশে’ কিছু ইউনিকোড বাংলা ফন্ট এবং কি-বোর্ড লেআউট বাজারে ছাড়ে। কিন্তু এইসব কি-বোর্ড লেআউটগুলি সবকটি ছিল বেশ কঠিন। বিশেষত, ইংরেজি কি বোর্ড লেআউটে অভ্যস্ত বাংলাভাষী ব্যবহারকারীদের পক্ষে সেটি বেশ জটিল ছিল। তাই ২০০১-এ শুরু হলেও, বাংলা ভাষায় ইন্টারনেট গড়গড়িয়ে এগোয়নি।
এই ফাঁক পূরণ করেন ময়মনসিং মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্র মেহদি হাসান খান। তিনি ‘ফোনেটিক’ বাংলা কি-বোর্ড লেআউট সমৃদ্ধ ‘অভ্র’ তৈরি করেন (প্রথম প্রকাশ ২০০৩ সালের মার্চ মাস)। সত্যি কথা বলতে, অভ্র কোনো কি-বোর্ড লেআউট নয়, এটি একটি মধ্যবর্তী স্তর। এতে k টিপলে ‘ক’ আসে। ইংরেজি কি-বোর্ড লেআউটে অভ্যস্ত বাংলাভাষীর সেই অভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে বানানো এই বুদ্ধিদীপ্ত সফ্টওয়ারটির কল্যাণে বাংলা কম্পিউটিং-এ জোয়ার আসে। বাংলা টাইপ করা খুবই সহজ হয়ে যায়। ইন্টারনেটে বাংলাতেও জোয়ার আসে। এই ‘অভ্র’ সফ্টওয়ারটি খুব সহজে বিনা পয়সায় ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে নিয়ে মাইক্রোসফ্ট উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমওয়ালা মেশিনে ইনস্টল করে নেওয়া যায়। মেহদি হাসান উন্মুক্ত এবং মুক্ত সফ্টওয়ার-প্রেমী লোক হওয়া সত্ত্বেও প্রথমদিকে অভ্র-র প্রোগ্রামটিকে প্রকাশ করেননি বা অভ্রকে মুক্ত করেননি। কারণ, তাঁর ভয় ছিল, এই প্রোগ্রামটিকে মুক্ত করে দিলে অন্য কেউ এই প্রোগ্রামটিকে ব্যবহার করবে পাসওয়ার্ড বা অন্যান্য গোপন জিনিস তুলে নেওয়ার কাজে। যেহেতু অভ্র একটি কি-বোর্ড লেআউটের মধ্যবর্তী স্তর, তাই তার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে কি-বোর্ডে যা টাইপ করা হচ্ছে, তা তুলে নেওয়া খুব সোজা। আমার মনে হয়েছে, এই কাণ্ডজ্ঞান বাংলাদেশের কম্পিউটার জগতের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য, তার উৎকর্ষের কারণও বটে। (প্রসঙ্গত বলা ভালো, পশ্চিমবঙ্গেও যে ২০০২-২০০৩ সাল নাগাদ বাংলায় কম্পিউটার বা মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্স নিয়ে সাড়া পড়েনি তা নয়। লিনাক্সের বাংলা সংস্করণের প্রকল্প ‘অঙ্কুর’-এ জড়িয়ে ছিল দক্ষিণ কলকাতার স্কুল ছাত্র সায়মিন্দু, বাংলায় লিনাক্স শেখার একটি অসাধারণ বই লিখেছিলেন নবীন শিক্ষক দীপঙ্কর। তার আগে শত শত প্রোগ্রামারের বানানো মুক্ত পেজ মেকিং সফ্টওয়ার ল্যাটেক-এ বাংলা জুড়েছিলেন বিজ্ঞান গবেষক পলাশ বরণ পাল।)
একইসঙ্গে ইন্টারনেট ডায়েরি বা ওয়েবলগ বা সংক্ষেপে ব্লগে বাংলায় যা খুশি লিখে প্রকাশ করা শুরু করে বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা। তার একটু বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া যাক। ইন্টারনেটে স্বাধীন ছোটো প্রকাশনার মূল হাতিয়ারই হল এই ব্লগ। গুগল কোম্পানির বদান্যতায় এই ব্লগ বিখ্যাত হয়ে ওঠে, তারা ব্লগার ডট কম নামে একটি ওয়েবসাইট কিনে নেয় এবং সেখানে অতি সহজে ব্লগ তৈরির ব্যবস্থা হয়। পশ্চিমবঙ্গের কেউ কেউ ব্লগে বাংলা লেখার ব্যাপারে প্রাথমিক দিনগুলিতে উদ্যোগ নিলেও তারা বাংলা ব্লগ নিয়ে তারপর আর মাথা ঘামায়নি। ইংরেজিতে ব্লগ লিখে দুনিয়ার কাছে পৌঁছে দেওয়াতেই বেশি উৎসাহ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা বাংলায় ব্লগ লিখতে শুরু করে। প্রথম ধারাবাহিকভাবে বাংলা ব্লগ লিখতে শুরু করেন বাংলাদেশের রেজওয়ান ইসলাম, ঠিকানা http://amibangladeshi.blogspot.com, নাম ‘ছেঁড়া পাতার কথামালা’। রেজওয়ান ২০০৩ সালে ইংরেজিতে ব্লগ লিখতে শুরু করেন, ২০০৪ সালের এপ্রিলে বাংলায় শুরু করেন। তাঁর ব্লগ লেখার শুরু নিয়ে লেখা, ‘সেটি ছিল ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসের কোনো এক দিন। তখন ইরাক যুদ্ধের গরম খবরে পূর্ণ পত্রিকাগুলো। হঠাৎ দেখলাম সালাম পাকশ-এর ওয়েবলগ সম্পর্কে একটি লেখা। ওটি ছিল ব্লগার-এ হোস্ট করা। সালাম এবং অন্যান্যদের লেখা পড়ে আমার অন্য একটি জগৎ উন্মোচন হল। আমার মনে হল, আমারও অনেক কিছু বলার আছে। উৎসাহী আমি নিজেই একটি ওয়েবলগ শুরু করলাম ‘তৃতীয় বিশ্বের চোখে’। প্রথম দিকে আমার যাত্রা ছিল উদ্দেশ্যবিহীন। তারপর লক্ষ্য করলাম যে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের তেমন একটা ধারণা নেই। শুধু হেডলাইনে পড়া খারাপ খবরগুলো (বন্যা, দারিদ্র্য, মৌলবাদ) দিয়েই দেশের পরিচয়। এদেশের মানুষদের তো আর সেই ভুল ভাঙানোর তেমন সুযোগ নেই। তখন মনে হল ওয়েবলগ হতে পারে বাংলাদেশিদের সেই কণ্ঠস্বর।’ পরে বাংলায় ব্লগ লেখা শুরু করার পর রেজওয়ান দৈনন্দিন জীবন নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট (একটি পোস্ট মানে একটি প্রকাশনা) দেওয়া শুরু করেন। তার একটি নমুনা, ‘আজ আমার খুব উদাস লাগছে। আবহাওয়াটা কেমন যেন। বাইরে কাঠফাটা রোদ্দুর। অফিসের ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্তর কাজ করছে কিন্তু আমার মনকে ঠান্ডা রাখতে পারছে না। খালি মনে হচ্ছে আমি এসব কী করছি কেন করছি। …’
২০০৫-০৬ থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় কমিউনিটি ব্লগিং। অর্থাৎ একটাই ব্লগ-ঠিকানায় একাধিক ব্লগার-এর ব্লগ (ব্লগ যারা লেখে তাদের বলা হয় ব্লগার। আগেই দেখেছি আমরা, ব্লগ লেখার প্রযুক্তি সম্বলিত ওয়েবসাইটটির নাম ছিল ব্লগার ডট কম)। ২০০৫ সালে তৈরি হয় ‘বাঁধ ভাঙার আওয়াজ’ ব্লগ, যার ঠিকানা www.somewhereinblog.com. ২০০৭ সালে এটাতে খুব সহজে ওয়েবপেজেই এমবেড করা বাংলা ইউনিকোড এবং ফোনেটিক কি বোর্ড লেআউটগুলি দিয়ে ব্লগ লেখার বন্দোবস্ত হয়। ওই একই সময় আরও কয়েকটি কমিউনিটি ব্লগ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয় বাংলাদেশে, যেমন সচলায়তন প্রভৃতি। এখন এইসব ব্লগ প্ল্যাটফর্মগুলিতে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ব্লগার রয়েছে। এই ধরনের ব্লগ প্ল্যাটফর্মের সংখ্যাই কয়েকশো। বাংলাদেশের ব্লগ নিয়ে বই-ও বেরিয়েছে, বাংলা ব্লগের ইতিবৃত্ত, প্রকাশক শুদ্ধস্বর (২০১২)। বাঁধ ভাঙার আওয়াজ বা সামহোয়্যার ইন ব্লগ (ডাকনাম সামু) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো কমিউনিটি ব্লগ, এটাতে ব্লগারের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। এই ব্লগ প্ল্যাটফর্মটির মালিকের একটি সাক্ষাৎকারে এই ব্লগটির সূচনা সম্পর্কে কথা রয়েছে, ‘… সেই সময় সারা বিশ্বে ইন্টারনেটের জয়জয়কার। সবাই ভার্চুয়াল জগতে লিখে মেধাচর্চা বা মতপ্রকাশে ব্যস্ত। যার মাধ্যম ছিল প্রধানত ইংরেজি। আমাদের দেশেও কিছু মানুষ ইংরেজিতে আগে থেকেই ব্লগিং করতেন। তাতে স্বভাবিকভাবেই ইংরেজিতে যারা দূর্বল তারা মুক্তবুদ্ধি চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। আবার ইংরেজিতে পারদর্শীরাও ইন্টারেনেটে বাংলায় লেখার প্ল্যাটফর্ম খুঁজে বেড়াতেন। প্রকৃতপক্ষে ‘ব্লগিং’ ধারণাটি তখনও ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জনমত তৈরির মূলধারার মাধ্যমগুলোতে যখন দ্বিপাক্ষিক অংশগ্রহণ সম্ভব নয় তখন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রাত্যহিক জীবনের আলাপচারিতায় সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি মাথায় রেখে এই বাংলা কমিউনিটি ব্লগিং-এর শুরুটা করে দেয় সামহোয়্যার ইন।’ বাংলাদেশের ব্লগ জগতের অন্যতম বড়ো প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এই ব্লগটিতে যারা নিয়মিত ভিজিট করে তারাই জানে, এটি দেখতে তেমন ঝিনচাক নয় বা স্মার্ট নয়। এটির জাতীয়তাবাদ, প্রগতিশীলতা, মাতৃভাষা প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি বেশ পক্ষপাত আছে। আর যাই হোক, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বড়োসড়ো কিছু মানেই যেমন তা কর্পোরেট কিছু, এটি তা নয়। প্রতিদিন এটাতে অসংখ্য ছোটো বড়ো পোস্ট আসে, এবং বিভিন্ন বিষয়ে। এইসব ব্লগ প্ল্যাটফর্মগুলির বড়ো বৈশিষ্ট্য হল, এর প্রতিটি পোস্ট-এর নিচের পাঠকের মন্তব্য সেকশনটি।
বাংলাদেশে মাতৃভাষায় ইন্টারনেটের এই প্রচেষ্টা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের ডোমেনগুলির মধ্যে বাংলায় একটি সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ এবং একটি বাংলা মাইক্রো ব্লগিং ওয়েবসাইট (অনেকটা ‘ট্যুইটার’ ও ‘রেডিট’-এর মতো) ‘বেশ তো’ শুরু হয়েছে কয়েকদিন আগে। এবং রাষ্ট্রীয় মদতে নয়, কর্পোরেট প্রচেষ্টাতেও নয়। বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের নতুন প্রজন্মের হাতেই তৈরি হয়েছে এগুলো।
স্বাধীন, মুক্ত পরিসর
বাংলাদেশের ব্লগের আরেকটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হল, তার মুক্ত পরিসর। ব্লগ মাধ্যমটিরই একটা পরিচয় হয়ে গেছে, তা পার্টিগুলির দলাদলির বিরুদ্ধে। ধর্ম নিয়ে অতি-সংবেদনশীল কিছু ব্লগার থাকলেও, ব্লগ পরিসরটি মূলগতভাবে ধর্মের ধার ধারে না। বরং ধর্ম নিয়ে সংবেদনশীলতার, বিশেষত বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের ন্যাকামির বিরুদ্ধে। কিছু কিছু ব্লগার তো ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধেই সরাসরি লেখে। কর্পোরেট বিরোধিতাও ব্লগে প্রবল। মোদ্দায় বলা যায়, বাংলাদেশের ‘মেইনস্ট্রিম’কে একহাত নেওয়ার ঠিকানা এই ব্লগ। এবং সেখানে প্রায় কোনো কিছুকেই রেয়াত করা হয় না। কাছা খুলে দেওয়া হয়। এই ‘মুক্তবুদ্ধি চর্চা’র এত বড়ো একটা পরিসর সেদেশের মেইনস্ট্রিমের নজরে খুব একটা আসেনি। অথবা নজরে আসার আগেই ব্লগ বাংলাদেশের একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। যার প্রকাশ ঘটেছে শাহবাগ আন্দোলনের উদ্যোক্তা সংগঠন হিসেবে ‘ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন একটিভিস্টস নেটওয়র্ক’ আত্মপ্রকাশ করার মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম — সংবাদপত্র প্রথম আলো বা আমার দেশ, পার্টি আওয়ামি লিগ বা বিএনপি — যারাই হোক, চোখ কচলে দেখেছে, গোকুলে বেড়ে উঠে সামাজিক শক্তি হিসেবে, শিক্ষিত বাঙালির নিজস্ব আন্দোলন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বাংলা ব্লগ।
বাংলাদেশের ব্লগগুলি মানবসমাজের মতোই বিচিত্র এবং সৃষ্টিসুখের উল্লাসভূমির মতো। কতখানি মুক্ত পরিসর এটা, এবং কতটা পরিণত, তা নিয়মিত ব্লগগুলি অনুসরণ না করলে ঠিক বোঝা যাবে না। তবে কিছু উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত সমাজের কাছে বাংলা ভাষার আবেগ বা চেতনা কোনো আদর্শ হিসেবে কাজ করে না, অন্তত চারপাশে তাকিয়ে তেমনটাই মনে হয়। বলে ফেলাই ভালো, পশ্চিমবাংলার শিক্ষিত সমাজের নব প্রজন্ম আদর্শহীন। আমরা কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে, আড্ডাখানায় তার প্রমাণ পাই। এক যুগ আগেও টিমটিম করে টিঁকে থাকা বামপন্থী আদর্শটি বাম রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে পড়ে বিদায় নিয়েছে। এর বাইরে আর কোনো কিছু নেই। বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের নয়া প্রজন্মের কাছে কাছে কিন্তু একখানা আদর্শ রয়েছে। সেটি হল, মাতৃভাষার আদর্শ ও স্বাধীনতার চেতনা। সেই আদর্শের জন্য শহিদ হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের গর্ভে জন্ম নিয়েছে এই প্রজন্ম। সেই শহিদদের মধ্যে ছিল প্রথিতযশা বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী। ফলে বাংলাদেশের শিক্ষিত নবীন প্রজন্মের মধ্যে সেই আদর্শ এখনও উজ্জ্বল।
ওই মেহদি হাসান, খুব অনিয়মিত ব্লগ লেখেন সচলায়তন নামক ব্লগ প্ল্যাটফর্মটিতে। সেখানে লিখেছিলেন একটি ব্লগ, নাম ‘ক্ষত’, ১৪ ডিসেম্বর ২০১২ — ‘আমরা যারা ড. জাফর ইকবালের বই পড়ে বড়ো হয়েছি, রাশেদের সাথে সেই যুদ্ধে আমরা সবাই ছিলাম। যুদ্ধে শহিদ হয়ে যাওয়া সব রাশেদ ছিল আমাদের বন্ধু, আমাদের ভাই। আমরা যারা ড. জাফর ইকবালের বই পড়ে বড়ো হয়েছি, তারা জানতাম সবসময়, একজন বিখ্যাত মানুষ দিয়ে কিছু হয় না, কিন্তু একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেওয়া যায়। আমাদের মধ্যে কখনো সাম্প্রদায়িকতার স্থান ছিল না, আদিবাসী থোয়াংসা চাই ছিল আমাদের প্রাণের বন্ধু। আমরা যারা ড. জাফর ইকবালের লেখা শিশুসাহিত্য এখনো পড়ি, আমরা জানি এখন তিনি লিখে যান ডরেমন আর হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। … বেল অথবা ক্যালটেকে অনায়াসে যিনি নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন, সেই একজন ড. জাফর ইকবাল খ্যাপার মতো এদেশে পড়ে থেকে প্রজন্ম গড়ার জন্য লড়াই করে যান। প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর এলে এই কথাগুলো মনে হয়। কত অভাগা আমরা! এরকম একশোজন খাঁটি মানুষ বেঁচে থাকলে কত সহজে এই দেশটা পাল্টে দেওয়া যেত!’
এই মেহদি হাসানেরই আরেকটি ব্লগ ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে, সচলায়তনে, শিরোনাম, ‘সময় থাকতে ফেসবুক নিয়ে ধান্দাবাজি বন্ধ করেন, গ্রামীণফোন’। এই গ্রামীনফোন হল মোবাইল কর্পোরেট টেলিনর-এর বাংলাদেশি রূপ। এরা একটি বিজ্ঞাপন ছাপে, তাতে লেখে, ফেসবুকের বাংলা অনুবাদের কাজে হাত দিচ্ছে তারা, এবার বাংলাভাষায় ফেসবুক অনুবাদের কাজে হাত দিতে পারবে বাংলাদেশিরা। বলাই বাহুল্য, এটা একটা বাজে কথা। ফেসবুক অনুবাদের কাজে শত শত বাংলাভাষী এর মধ্যেই অংশ নিয়ে ফেলেছে, অর্ধেকের বেশি কাজ হয়েও গেছে। ব্লগে লেখা হয়, ‘কোনোরকম কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান অথবা ‘বাংলা ভাষার আপন কাগুদের’ সাহায্য ছাড়া ফেসবুকের অর্ধেকের বেশি বাংলা লোকালাইজেশনের কাজ শেষ হয়েছে, বাকিটাও হবে। যেমনভাবে হয়েছে উইকিমিডিয়া, ফায়ারফক্স, অপেরা, ওয়ার্ডপ্রেস, পানবিবি, পিএইচপিবিবি, নোম ইত্যাদি অসংখ্য সফ্টওয়ারের লোকালাইজেশনের কাজ। আমি বাংলা কম্পিউটিং সংক্রান্ত খবরের খোঁজ রাখার চেষ্টা করি সবসময়, তারপরও যেসমস্ত স্বেচ্ছাসেবক নিজের ব্যক্তিগত সময় এবং শ্রম দিয়ে এসব কাজ করেছেন তাঁদের বেশিরভাগকেই চিনি না। কারণটা খুব সহজ, আত্মপ্রচার নিয়ে তাঁরা লালায়িত নন। তাঁরা যেটা করছেন বা করছেন সেটা নিজের ভাষার জন্য ভালোবাসা থেকে আসা দায়িত্ববোধ থেকেই। তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে শিখুন। গ্রামীণফোন যেখানে এখন পর্যন্ত বুঝেও উঠতে পারে নাই লোকালাইজেশন প্রজেক্ট কিভাবে চলে, সেখানে ‘… গ্রামীণফোন ও ফেসবুক যৌথভাবে এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে আপনি চাইলেই হতে পারেন এর সফল অনুবাদক…’ এ ধরনের নির্লজ্জ মিথ্যাচার বন্ধ করুন। ফেসবুকে অনুবাদক হতে হলে কোনো ছাতা ফোনেরও দরকার নাই, যদু-মধু-কদু সবাই হতে পারে। আপনারা কী খান জানি না, কিন্তু পাবলিক ‘যা গিলাবেন তাই খাবে’ এটা ভাবলে এখনও বোকার স্বর্গে আছেন।’
একটি ব্লগের কথা না বলে পারছি না, মতিকন্ঠ নাম। খুব অশ্লীল ভাষায় যাবতীয় মাতব্বরদের (ইউনুস থেকে হাসিনা, খালেদা থেকে সাঈদি) গালি দেওয়া হয় তাতে, সংবাদকে বিকৃতভাবে প্রকাশ করার মাধ্যমে। সাইটটির দাবি, দৈনিক দুই লক্ষের বেশি লোক সাইটটি দেখে। এর প্রতিটি পোস্টই অসাধারণ, অশ্লীল ও রাস্তার ভাষা ব্যবহার আর আরবী-বাংলা মিশ্রিত শব্দচয়নে নির্মাণ করা আঙ্গিকে, এবং বিষয়বস্তুতে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের কারণে। একটি উদাহরণ : ‘সাভারে বিধ্বস্ত ভবন রানা প্লাজার মালিক ও সাভার যুব লিগের নায়েবে আমীর মো. সোহেল রানা বলেছেন, শেখ হাসিনা যুব লিগের কেউ নহে। আজ বাংলাদেশ হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ও ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী অ্যাডভকেট সাহারা খাতুনের মালিকানাধীন এমপেরিয়াল হোটেল এন্ড গেষ্ট হাউসে আত্মগোপন রত অবস্থায় মতিকণ্ঠকে দেওয়া এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন সোহেল রানা।
সোহেল রানা বলেন, আমি আজ টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা উপভোগ করছিলাম। এক ফাঁকে খবরে দেখলাম, প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী ভাষাকন্যা গণতন্ত্রের মানসকন্যা ড. শেখ হাসিনা বলছেন, সোহেল রানা যুব লিগের কেউ নহে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে রানা বলেন, আমি এর জবাবে বলতে চাই, শেখ হাসিনা যুব লিগের কেউ নহে। প্রমাণ হিসাবে যুব লিগের সকল নেতা-কর্মীর নামের তালিকা সম্বলিত একটি জাবেদা খাতা উপস্থাপন করে সোহেল রানা বলেন, এখানে কুথাও শেখ হাসিনার নাম নাই।
প্রধানমন্ত্রীকে নিজের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সোহেল রানা বলেন, আওয়ামি লিগের সংসদ সদস্য তৌহিদ জং মুরাদ নিজে আমায় কুলে করিয়া রানা প্লাজা হতে বাইর করছে। আমি যুব লিগের কেউ না হলে সে আমায় কুলে লইত?
আবেগঘন কণ্ঠে রানা বলেন, ‘হিন্দুর জমি দখল করিয়া, পুষ্করিনী ভরাট করিয়া, পৌরসভার অনুমদনের পুটু মারিয়া তুললাম আলিশান ভবন। আমি যুব লিগের কেউ না হইলে এইসব কেমনে তুললাম? … তার নামে গ্রেফতারি পরয়ানার কথা জানালে রানা বলেন, কুথায় কুন পুলিশ রেবের বাচ্চা আমায় গ্রেফতার করবে? কয়েকটা দিন এমপেরিয়ালের সকল নাগরিক-সুবন্দবস্ত উপভোগ করিয়া আগরতলা চলে যাব। মখা সারকে টেকাটুকা দেওয়া হইছে। পরয়ানা থাকবে পরয়ানার জায়গায় আমি থাকব আমার জায়গায়। পরয়ানার পরয়া না করি।’
এই পোস্টটি সাভারে ছশোর বেশি শ্রমিক কারখানা ভবন চাপা পড়ে মারা যাওয়ার পর দেওয়া হয়েছে। ভবনটির নাম রানা প্লাজা, মালিক সোহেল রানা নিয়ে যেসব তথ্য এখানে দেওয়া হয়েছে, যেমন মুরাদ নামে আওয়ামি লিগের এক নেতা রানাকে উদ্ধার করেছে, কী করে বানানো হয়েছে রানা প্লাজা, হাসিনা বলেছেন যে রানা যুব লিগের কেউ না, এবং রানার লুকোনোর জায়গা — সবগুলিই সত্য এবং সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর আগে গার্মেন্টস কারখানা তাজরিন ফ্যাশন্স-এ আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিক মারা যায়, কারণ আগুন লাগার পর মালিক বাইরের গেট বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই ঘটনার পরও তাজরিন মালিকের কিস্যু হয়নি। যাই হোক, নির্মম সত্যগুলির ওপর ভিত্তি করে লেখা এই ‘খবর’টি। সঙ্গে একটি ফটোগ্রাফ — তাতে যুব লিগের সাভার ইউনিটের একটি পোস্টারে রানার ছবি ও নাম। বাংলাদেশের ঘুণ ধরে যাওয়া রাজনৈতিক সমাজের প্রতি এক থাপ্পড়ের মতো এটি। এইরকমই দিনে অন্তত একটি পোস্ট-এ বাঙলাদেশের সমস্ত মাতব্বরদের নাঙ্গা করে দেয় দৈনিক মতিকন্ঠ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো মিডিয়ার নাম প্রথম আলো, আমাদের আনন্দবাজারের মতো তার দাপট সেখানে। সেই কাগজের সম্পাদকের নাম মতিউর রহমান। সেই কাগজকে ব্যঙ্গ করেই নাম দেওয়া হয়েছে দৈনিক মতিকন্ঠ — সন্দেহ নেই।
প্রয়োজনে এই বড়ো মিডিয়াকে কেমন একহাত নিতে পারে ব্লগাররা, তার একটা নমুনা দেওয়া যাক। এ বছর পয়লা বৈশাখে প্রথম আলো পত্রিকাটিতে একটি সাপ্লিমেন্ট বেরোনোর কথা ছিল, তার অনলাইন কপি, যেটি প্রিন্টের আগে প্রকাশিত হয়, তাতে ১৩ এপ্রিল দুটি গল্প ছাপা হয়েছিল — একটি একুশে পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই এবং অন্যটি প্রথম আলোর নিজের বানানো একজন লেখকের। প্রথম লেখার উপজীব্য ছিল, মফস্বল থেকে এসে শাহবাগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া মেয়েরা শাহবাগের পুরুষ নেতাদের শয্যাসঙ্গিনী হচ্ছে, কখনো বা হতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয় লেখার উপজীব্য, শাহবাগ আন্দোলন বড়োলোকেদের ব্যাপার, এখানে বড়োলোকের ছেলেরা এসেছে গার্ল ফ্রেন্ড জোটানোর আশায়। গল্প হিসেবে অতি মামুলি ওইদুটি যে শাহবাগ আন্দোলন সম্পর্কে জামাত-শিবিরের অপপ্রচারকেই ইন্ধন দেয়। প্রথম আলো শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষ নেওয়ার ফলে কাগজের শাহবাগ বিরোধী পাঠক যারা মুখ ফিরিয়েছে তাদের ফের কাছে টানতেই যে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ ওই দুটি গল্প প্রকাশ করতে চাইছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া শাহবাগ বিরোধী পত্রিকা আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার ২ লক্ষ পাঠককে পাওয়ার চেষ্টাও ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন ব্লগে এই দুটো গল্পের বিরুদ্ধে তীব্র আওয়াজ ওঠে। পরদিন সকালে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে। অবস্থা সঙ্গীন বুঝে প্রথম আলো ১৫ এপ্রিল গল্প দুটি প্রত্যাহার করে নেয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই গল্প প্রসঙ্গে ওই সময় প্রকাশ হওয়া দুটি ব্লগের কিছু অংশ এখানে দিচ্ছি। প্রথমটি, ‘আমার ব্লগ’ নামক ব্লগ প্ল্যাটফর্মে রিনভি তুষার নামে একজন ১৬ এপ্রিল তিনি লেখেন, ‘… আমার বলাতে আর কীইবা আসে যায়? কোনো জনপ্রিয় লেখক, কবি বা সাহিত্যিক এর প্রতিবাদ করবেন না। কোনো নায়িকা, নায়ক, গায়িকা, গায়ক (যাদের আমরা শাহবাগ গণবিস্ফোরণের কল্যাণে অনেক সাধারণ হিসাবে আবিষ্কার করেছি), কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও এর প্রতিবাদ করবেন না। ওনারা ভালো করেই জানেন, ওনারা জনপ্রিয়। কারণ ওনারা প্রথম আলো-র প্রিয়। জনপ্রিয় থাকতে হলে আর জনপ্রিয় হতে হলে সবই করা যায়, শুধুমাত্র প্রথম আলো-র সমালোচনা করা যায় না। সালাম ঠুকতে হয় নিয়মিত প্রথম আলো-কে। ওনাদের মগজের সম্পূর্ণ ঠিকাদারি প্রথম আলো-র হাতে। প্রথম আলো যেমন গান গাইতে বলে তেনারা তেমন গানই গান। প্রথম আলো যে জলে নাইতে বলে তেনারা সে জলেই সারেন স্নান। শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ দিনের খামের লোভে, নিমন্ত্রণের লোভে। কয়েক ইঞ্চি সাদা-কালো (বিশেষ খাতিরে রঙিন) কাভারেজ-এর লোভে ওনারা প্রথম আলো-র কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন।’
অন্য একটি ব্লগ প্ল্যাটফর্ম সচলায়তনে হিমু লেখেন ১৬ এপ্রিল, ‘আরাধ্য যে তৃতীয় শক্তি নিয়ে অধ্যাপক ড. ইউনূসের নোবেলজয়ের পর দৈনিক প্রথম আলোর নেতৃত্বে আরও কিছু পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম নিরলস প্রচার চালিয়েছে, এ ধারণাটিকে ‘খাওয়াতে’ চেয়েছে মানুষকে, সেই তৃতীয় শক্তির কল্পিত ছবিটিকে মাড়িয়ে দলে মুচড়ে একাকার করে এক ভিন্ন তৃতীয় শক্তি শাহবাগে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এ যেন মঞ্চে বাঘের ছাল গায়ে অভিনেতার বদলে সুন্দরবনের বাঘেরই উপস্থিতি। অনভিজ্ঞের কাছে, ভুক্তভোগীর কাছে, বহুলপ্রত্যাশীর কাছে, রূপমুগ্ধের কাছে বা ধান্দাবাজের কাছে বাঘছালে ঢাকা মানুষ আর আসল বাঘের মধ্যে পার্থক্য না-ও থাকতে পারে, কিন্তু সে বাঘ যার মুখোমুখি হবে, সে জানে, পার্থক্য কোথায়। তাই শাহবাগ নিয়ে মিডিয়ার উদ্বেগও যথেষ্ট স্পষ্টই ছিল। দৈনিক প্রথম আলো সহ কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল প্রথম কিছুদিন চেষ্টা করেছে, শাহবাগের বাঘটির মুখে নিজেদের কথা বায়ুস্বননের। মাহবুব রশীদ বা ফারুক গুয়েবাড়ার মতো উটকো লোকজনকে তাই আমরা শাহবাগের প্রতিনিধি হিসেবে পত্রিকা ও টিভিতে প্রলাপ বকতে দেখেছি। … টিভিতে রাতের টক শো ও পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতায় মিডিয়ার এই হালুমরূপী পোষ্য ম্যাওয়ের প্রাদুর্ভাব গত পাঁচ বা সাড়ে পাঁচ বছর ধরেই দৃশ্যমান। … সেখানে লিগভাবাপন্ন মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপিভাবাপন্ন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর বা জামাতভাবাপন্ন আসিফ নজরুল নয়নমনোহর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে পাশাপাশি বসেন, নানা কথা বলেন। …’
উপসংহার
বাংলাদেশে ব্লগার প্রজন্ম নিঃসন্দেহে সেখানকার শিক্ষিত সমাজ, এলিট সমাজের লোক। কিন্তু তার কোনো বাঁধন নেই। না রাজনীতির সাথে, না এনজিওর সাথে, না ধর্মের সাথে, না কর্পোরেটের সাথে, না মিডিয়ার সাথে। এই বাঁধনহীনতার কারণেই সে বিচ্ছিন্নও বটে। ঢাকার অদূরে সাভারে যখন ছশো শ্রমিক মারা যাওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, তখন প্রায় প্রতিটি ব্লগেই অসংখ্য শোক, রাগ, ক্ষোভ ফুটে বেরিয়েছে। ঠিক যেমন শাহবাগের আন্দোলনের পাশে নিরঙ্কুশ ভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ব্লগগুলি। ঠিক যেমন বাংলাদেশ সরকার এই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে একের পর এক ব্লগারকে আটক করলে তার বিরুদ্ধে কালা দিবস ও ব্লগ ধর্মঘট পালন করেছিল বেশির ভাগ ব্লগ ও ব্লগ প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু বিভিন্ন ব্লগারের লেখা পড়ে মনে হল, সাভার ঠিক কোথায়, কীভাবে সেখানে যেতে হয়, সে বিষয়ে অজ্ঞতা রয়েছে এবং তার প্রকাশেও তারা কুণ্ঠাহীন। হ্যাঁ, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি আন্তরিক দরদ যেমন তাদের আছে, তেমনই তাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাও যে আছে সে বিষয়ে সে ওয়াকিবহাল এবং তা স্বীকারেও তার অস্বস্তি নেই। শাহবাগ আন্দোলনের শ্লোগান কন্যা, একটি বামপন্থী ছোটো ছাত্র সংগঠনের কর্মী লাকি আক্তার যখন এই এপ্রিলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দেয় গ্রাম মফস্বলে গিয়ে কৃষিজীবী শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার ডাক দিয়ে, তা যে ব্লগার প্রজন্মকে খুব নাড়া দেয় তা বলা মুশকিল। এ একাধারে বিচ্ছিন্নতা, আবার যেহেতু এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ভেতরে কোনো খেদ নেই, তাই তা বাঁধনহীনতাও বটে। তাই, যে দেশের সিংহভাগ মানুষের জীবনযাপন বেশ কঠিন কঠোর এবং যে দেশে বন্যা, খরা, সাইক্লোন বা কারখানা ধসে পড়ে/আগুন লেগে গণমৃত্যুর মতো ট্র্যাজেডি আকছার ঘটছে, সেই দেশেই ব্লগার প্রজন্ম এতটা স্বাধীন সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন হতে পারে। এই স্বাধীনতা বা বাঁধনহীনতা কোনো খারাপ জিনিস নয় বলেই আমার মনে হয়। শাহবাগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা একে অনেকটাই জনমুখীও করেছে। সাভার ট্র্যাজেডির পর ব্লগার প্রজন্মের দল বেঁধে উদ্ধারকাজে নেমে যাওয়া, অনাথ হওয়া বাচ্চাদের ভরণপোষণ, আহতদের চিকিৎসা সহায়তা, পীড়িত শ্রমজীবীদের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার বন্দোবস্তের মধ্যেই তার ইঙ্গিত আছে। তবে বাংলাদেশের অগণিত শ্রমজীবী কৃষিজীবী মানুষ কীভাবে এই প্রজন্মের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত রাখবে তা কে জানে! এনজিও মার্কা ইউনিয়ন বা পার্টি দিয়ে যে তা হবে না তা নিঃসন্দেহ, কারণ এই প্রজন্ম বিন্দুমাত্র ধান্দাবাজি, যা ওই ধরনের সংগঠনগুলির বৈশিষ্ট্য, তাকে রেয়াত করবে না।
সাম্প্রতিক মন্তব্য