জিতেন নন্দী। কলকাতা। ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১।#
সে এক রসিক পাগল
সন্ধ্যা নেমেছে সবে। অনুষ্ঠান শুরু হবে। লোকটা দাঁড়িয়ে আছেন একটু ঝুঁকে, এক পা সামনের দিকে, দু-হাতে খঞ্জনি, চোখ দুটো মঞ্চের দিকে স্থির। পরনে সাদা ধুতি, গায়ের জামা-সোয়েটার একটু ময়লা। আলগা নজরে সবাই বলবে পাগল। আমিও তেমনটাই ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু, ও হরি! এ আবার কেমন পাগল!
গোরভাঙায় এলাম এই প্রথম। উল্টোডাঙা থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল, তারপর টোটোতে বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে করিমপুর সুপার ফাস্ট বাসে নাজিরপুর, এরপর টোটোতে গোরভাঙা। এখানে টোটোকে বলে টুকটুক। মোট ছ-ঘণ্টার সফর।
টুকটুকওয়ালা বলেছিলেন, গোরভাঙা বাসস্ট্যান্ডে নামাবেন। কিন্তু আমিই শেষ যাত্রী। আমাদের নামিয়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন। মজা হল, ওঁর বাড়ি গোরভাঙা গ্রামেই। আমরা আজাহার ফকিরের অমর মেলায় যাব শুনে বললেন, ‘বসুন। আজাহার ফকির ছিলেন আমার জ্যাঠা আর মনসুর ফকির সম্পর্কে দাদা। এই গ্রামে সবাই আমাদের পরিবারের। ওই দেখুন পুকুরের পারে আমার বাড়ি। চলুন মেলায় নামিয়ে দিই।’ জিজ্ঞেস করলাম — আপনার নাম? — সাইদুল খান।
মেলার দোকানপাট পেরিয়ে আজাহার ফকিরের মাজার। ভিতরে চাদরে ঢাকা তাঁর সমাধি। দেয়ালের গায়ে লেখা আছে : জন্ম ৬ই ফাল্গুন ১৩৩২ সন/ইং ১৯২৬; মৃত্যু ২০শে আষাঢ় ১৪০৫ সন/ইং ১৯৯৯। মাজারের পাশে অনেকটা খোলা জায়গার ওপর মঞ্চ। একপাশে মেয়েদের বসার জায়গা, সামনে পুরুষদের। পাঁচদিনের মেলা। শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে রয়েছে আশপাশের পাড়া আর গ্রামের লোক। বাইরে থেকে যারা এসেছে তাদের মধ্যে নদিয়া জেলার লোকই বেশি। বাঁশি, দোতারা, বেহালা আর ঢোলের সমবেত বাদ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হল। তখনই সেই পাগলের দেখা মিলল। খঞ্জনি বাজিয়ে একাগ্র তিনি নাচছেন।
গানের ভেলায় চেপে টানা তিনঘণ্টা ভাবসাগরে ডুব দেওয়া, মাঝে কিছুটা রসভঙ্গ হল স্থানীয় নেত্রীর বেসুরো উপস্থিতিতে। কী করা যাবে? এই উপদ্রব তো কুষ্টিয়াতেও দেখে এসেছি পাঁচবছর আগে। ছেউড়িয়ায় লালন ফকিরের মাজারেও সরকারি কর্তাভজনা ছিল। তবে এসবই চলে মূল মঞ্চে। মেলার প্রাঙ্গণ ঘিরে ফকির আর রসিক মানুষের জটলায় সেসব নেই। রসভঙ্গ যখন হলই, যাই চারপাশটা একটু ঘুরে নিই। মেলার অন্যতম আকর্ষণ তেলেভাজা, পাঁপড়, ঘুগনি, ডিমভাজা, চা-কফি। তবে চোখে বেশি পড়ল কামারশালের নানান জিনিস। আর একটা খাবার খেতে গিয়েও পেলাম না — নতুন চালের গুঁড়ো আর খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠে ‘ধুকি’ — দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল।
গায়কদের মধ্যে ফকিরদেরই প্রাধান্য। আজাহার ফকিরের ছেলে মনসুর ফকির, শিষ্য গোলাম ফকিররা যেমন ছিলেন; উত্তরা বাউল, চাকদহের শঙ্কর গোস্বামীও গাইলেন। উত্তরা বাউল আর আমিরুল ফকির একসঙ্গে চমৎকার গাইলেন।
এখানে যারা গাইতে এসেছেন, যারা বাজনদার, যারা শ্রোতা-দর্শক সবাই রসিক মানুষ। তারা অল্পবিস্তর পাগলও বটে — নইলে এই গোরভাঙায় আসবে কেন — তবে যেন ওই লোকটির মতো নিখাদ নয়। নানান মাপের সেয়ানাগিরি আমাদের মনে ছায়া ফেলে — কেরিয়ার, পিএইচডি, বাউল-ফকিরের মেকআপে শিল্পী হয়ে ওঠা, সা-রে-গা-মা-পা … অথচ ওই লোকটির চোখ বলছে ওঁর অন্তর্দৃষ্টি স্থির, ভেতরে বইছে অনন্ত সংগীত : রস মন্দ মন্দর বাজতা …
সরকারি রসভঙ্গপর্ব কাটিয়ে গোরভাঙা আবার সংগীতে মগ্ন হয়ে ওঠে। চলে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত।
বারবার আমি পৌঁছে যাচ্ছিলাম পাঁচবছর আগের ছেউড়িয়ায়। মাজারের প্রশান্তি, পাশের সাদা কবরগুলো, সামনের গাছ আর চাতাল — কী অদ্ভুত মিল! এমনকী গানের গায়কি, গভীর বুকফাটা টান আর ভাবের খেলায় নদিয়া কুষ্টিয়া যেন একাকার হয়ে আছে। তবে অমিলও আছে। যেমন ‘যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান/জাতি গোত্র নাহি রবে/ এমন মানবসমাজ কবে গো সৃজন হবে’ গান দু-জায়গাতেই শুনেছি। কিন্তু কথা আর সুরে কিছু ফারাক আছে। মনসুরের কণ্ঠ তেমন মধুর নয়। তবুও যখন ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো’ উচ্চারণে কেঁদে ওঠেন, আমি কাঁদি, কাঁদে সীমান্ত ছাপিয়ে দুই পারের নদিয়া।
কুষ্টিয়ার সঙ্গে মিলের কথা বলতে মনসুর ফকিরের স্ত্রী বলেন, ‘তাই নাকি! আমি তো কোনোদিন বাইরে কোথাও যাই নাই, তা হবে।’ মনসুরের বাড়ির সকলেই খুব আলাপী। ‘ভাত খাইছেন’, ‘মুড়ি খেলেন’ জনে জনে খোঁজ নেন। কথায় কথায় ওঠে মনসুরের বাপ আজাহার ফকিরের কথা। ‘চৌদ্দ বছর ঘরের বাইর হলেন না আমার শ্বশুর। একা বসেছিলেন … উনি পাগলের ট্রিটমেন্ট করতেন। অমর নামে একজন পাগলকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল বাজারের মধ্য দিয়ে। উনি দেখে ওদের বললেন, বাঁধন খুলে দাও। তারপর সেই অমর ভালো হয়ে গেল। লেখাপড়া করল, চাকরি করল। আর অবাক কাণ্ড, আজাহার ফকিরের মৃত্যুর আগের মুহূর্তে চলে এল অমর। বাবার সঙ্গে দেখা করে ফিরে যেতে চাইল, চাকরি রয়েছে। বাবা বললেন, আমি তোকে বলে দেব কখন যেতে হবে। … বাবা নিজের মৃত্যুর সময়টাও জানতেন …
এইরকম ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি-কথা — মনসুরের ছেলে পিয়াস, ওদের মা আউড়ে যান আনন্দে। পিয়াস বলে, শুধু কুষ্টিয়ার ধারাই নয়, আজাহার ফকির ছিলেন খোদ লালন ফকিরের উত্তরসূরী। লালনের গুরু ছিলেন সিরাজ সাঁই। লালনের পরে এসেছিলেন দুদু মিঞা … মহেশ ফকির আর এইভাবে কয় পিড়ি পর ঈমান পণ্ডিতের শিষ্য হলেন আজাহার ফকির।
সত্যি গোরভাঙার চলনে-বলনে-আদতে এমনকী পুরুষদের চেহারায়, চোখ-নাক-মুখের গড়নে আর স্বভাবেও লালন ফকির আর ছেউড়িয়ার একটা আদল যেন ফুটে ওঠে। এই গ্রামে ঘরে ঘরে আজাহার-মনসুর ফকিরদের জ্ঞাতিদের বাস। গানবাজনার মধ্যেও রয়েছে একটা পরম্পরা-স্রোত। সে সোজাসাপটা বংশ-পরম্পরা নয় যে বাপেরটা ছেলেই পাবে। যেমন, গান আর দোতারার বাজনা শুনে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, আমিরুল ফকির হয়তো মনসুরেরই ছেলে। কিন্তু পরে জানলাম, উনি ওঁর মায়ের দিকের সন্তান। আর একজন খুব অবাক করেছিল, ঢোলবাদক রাজেন স্বর্ণকার। কথা বলে জানলাম, মাত্র ষোলো বছর বয়স ওর। কী কাণ্ড! — ‘তিন ঘণ্টা বাজিয়ে গেলে তুমি!’ ও বলল, ‘হ্যাঁ আমি ছ-সাত ঘণ্টাও বাজাই’। ওর বাবাও ছিলেন একজন ঢোলবাদক। পাশের গ্রাম গোয়াস-এ ওদের বাস। ওর দাদুর দাদুও ঢোলক ছিলেন। ছেউড়িয়াতেও এরকম ঢোল শুনেছি — একদিকে হাত দিয়ে আর একদিকে কাঠি দিয়ে বাজানো। ওর ঢোল শুনে আমার বুকের ভেতরে কেমন গুম গুম করে উঠতে থাকে। সমস্ত শরীর জুড়ে চলে একটা শিহরণ। ও কি তা জানে!
গোলঘরে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাতে শুয়েছি মাজারের পাশের ঘরে, তখন আড়াইটা হবে। সকালে ঘুম ভাঙল দোতারা আর ঢোলের প্রভাতী সুরে। গিয়ে বসলাম সামনে। মনসুর ফকির দোতারা বাজাচ্ছেন। ঢোলবাদক এসেছেন পলাশিপাড়ার ওদিক থেকে। পাশেই হারমোনিয়াম ধরলেন ওইদিকেরই একজন। তাঁর হরিনামের দল রয়েছে। একটা কম্বল লুঙ্গির মতো করে কোমরে জড়িয়ে ধূপ হাতে এলেন সেই রসিক-পাগল। হাতে বাজছে খঞ্জনি। মাথা নড়ছে। পা ফেলছেন একই তাল আর লয়ে। এরপর মুখে কয়েকটা বোল ধরলেন। ঢোলক জবাব দিলেন। হঠাৎ খানিকটা গেয়ে উঠলেন। হারমোনিয়াম-বাদক ওঁকে চিনতে পারলেন। পঞ্চাশ বছর আগে নাকি দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন সাগরপাড়া গ্রামে।
মেলার মাঝে, সকলের মাঝে সংগীত-মগ্ন সে এক রসিক পাগল।
Leave a Reply