২১ নভেম্বর, পারভেজ কুরেশি, কলকাতা (হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ জিতেন নন্দী)#
অসুর পুজোর কথা এর আগে কারও কাছে শুনিনি। শুনে বেশ অবাক হলাম আমি। অর্ণবদার কাছে শোনামাত্র আমি ভাবলাম যে ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখা দরকার। পুজোর ছুটি পেয়েছি যখন, দেখে আসি অসুর পুজো। কিছু অভিজ্ঞতা হবে।
আমি, গুড্ডু আর অর্ণবদা রাতের ট্রেনে আদ্রা পৌঁছে গেলাম। আদ্রা হল পুরুলিয়ার এক বড়ো জংশন স্টেশন। স্টেশন থেকে বাসে করে ৪৫ মিনিটের রাস্তা। বাস থেকে নেমে গ্রামে যেতে হলে হেঁটেই যাওয়া ভালো। কারণ অটো ওখানে খুব কমই চলে। আমরা অটোর জন্য এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে রইলাম স্টেশনের কাছে। স্টেশনের বাইরেই ছৌ নাচের একটা স্ট্যাচু রয়েছে। আমরা ওখানেই বসে গল্প করে সময় কাটালাম। কথায় কথায় আদিবাসী জীবনের প্রসঙ্গ এল — এখানে কী খাদ্য পাওয়া যায় আর ওরা কী খায়, ওদের বাড়িতে শৌচাগার আছে কি নেই। আমরা ছাড়াও অন্যান্য জায়গা থেকে আরও কিছু লোক এসেছে। অটোতে যেতে যেতে দেখছি অনেক জায়গা-জমি খালি পড়ে রয়েছে একদম জঙ্গলের মতোই। অনেক হনুমান ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা ঝিল দেখলাম, তার জল আকাশের মতো স্বচ্ছ আর পরিষ্কার। এত সুন্দর জলাশয় এর আগে আমি দেখিনি। এখানে জমি পাহাড়ের মতো উঁচু-নিচু। একটা ছোট্ট গলি পেরিয়ে অটোটা এসে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল।
সেখানে একটা স্কুলবাড়িতে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। এটা একটা বাংলাভাষী স্কুল। যিনি আমাদের এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, ওঁর নাম অজিত হেমব্রম। শৌচাগারের সামান্য অসুবিধা ছাড়া সমস্ত ব্যবস্থা ভালোই ছিল। কোনোরকমে স্নান সেরে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল। বাইরে একটা দোকান থেকে মুড়ি, আলুর চপ আর জিলিপি কিনে খেয়ে একটু আরাম হল। কিছুক্ষণ পর অজিত এসে জানালেন যে দুপুরের খাবার পেতে দেরি হবে, তাই ওঁরা মুড়ি আর ঘুগনির বন্দোবস্ত করেছেন। আমরা ফের খেতে বসে গেলাম। স্কুলের ক্লাসঘরের বেঞ্চিতে জঙ্গলের গাছের পাতা পেতে আমাদের বসানো হল। আমাদের সামনেই আদিবাসীরা মাটিতে বসে গেল খাবার জন্য। যা কিছু অনুষ্ঠান হবে রাতে। আমরা তাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম।
গ্রামটার নাম সোনাঝুরি। গাঁয়ের ভিতর ঢুকে দেখলাম যে কিছু ঘর মাটির, কিছু পাকা। বেশি লোকজন নেই। আর কিছুটা গিয়ে দেখি একটা ছোটো প্যান্ডেল। সেখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে। সামনে খেত, সেখানেও জমি উঁচু নিচু। চলতে চলতে একজন লোকের সঙ্গেও দেখা হল না। মনে হল, এই গাঁয়ে খুব কম লোক বাস করে। তারপর আমরা ভাবলাম যে আগে যে ঝিলটা দেখেছি, ওটা ফের দেখে আসি। খেত থেকে রাস্তা অনুমান করে এগোলাম। অনেকটা হেঁটেও ঝিল আর নজরে পড়ছে না। ভাবলাম, কাউকে জিজ্ঞেস করি। কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না। তাই আবার বসতির দিকে গেলাম। সেখানে কয়েকজনের দেখা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঝিলটা কোনদিকে? কেউই আমাদের কথা বুঝতে পারছে না। একজন বাংলায় বলে উঠল, এরা ড্যাম খুঁজছে। সে আমাদের রাস্তা বাতলে দিল। আমরা সেই পথে এগিয়ে এবার ঝিলটা দেখতে পেলাম। ঝিলের সামনে গিয়ে দেখি একটা হনুমান। আমাদের সঙ্গে ছিল গুড্ডু। সে বলল, হনুমান কিছু করবে না। যাই হোক, তবু ভয়টা পুরো কাটল না। এতটা এসে চলে যাব, তাই আমরা একটু তফাতে এসে বসলাম। একটু পরে হনুমানটা চলে গেল। এবার আমরা উঠে ঝিলের পার ধরে হাঁটতে লাগলাম। গুড্ডু হাতে একটা লাঠি নিয়ে নিল। সে বলল, এখানে সাপ থাকতে পারে। একটা সাপ আমার পায়ের পাশ দিয়ে চলে গেল। আর এগোনো যাবে না। আমরা গাঁয়ের দিকে ফিরে চললাম। গাঁয়ের লোকেদের দেখতে পেয়ে আমরা অসুর পুজোর কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারা এই কথা শুনে মোটেই খুশি হল না। কেউ কেউ একটু রেগেও গেল। যেতে যেতে একটা চায়ের দোকান পেয়ে আমরা চা খেলাম। চাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, এই গ্রামে একমাত্র সে-ই এই অসুর পুজোর পক্ষে। গাঁয়ের ভিতর জায়গায় জায়গায় হনুমান মন্দির রয়েছে। আমি অর্ণবদাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে হনুমান আছে বলেই হনুমান মন্দির করা হয়েছে? অর্ণবদা বলল, এ হল বিজেপির অবদান। গাঁয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে কিছু বিজেপি আর সিপিএমের পোস্টার রয়েছে। গ্রাম ঘুরে এবার আমরা স্কুলবাড়িতে ফিরে এলাম। সেখানে খিচুড়ি বানানো হয়েছে। আমরা ভরপেট খিচুড়ি খেলাম।
খেয়েদেয়ে আমরা স্কুলবাড়িতে বিশ্রাম নিতে গেলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম, এখানে লোকে রুটি খায় না, সকলেই ভাত খায়। গুড্ডু বলল, এই গ্রামে একজনও মুসলমান নেই।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। স্কুলবাড়ির লাগোয়া সুদৃশ্য কাপড়ে ঘেরা একটা মণ্ডপে অসুরের মূর্তি বসানো হয়েছে। সেখানে আদিবাসীদের নাচ-গান শুরু হয়ে গেল। একটা মঞ্চের ওপর মাইকে ওরা একটা প্রতিবাদ করছিল। পরে জেনেছি, দুর্গা পুজোর প্রতিবাদেই এই অসুর পুজোর প্রচলন রয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে।
রাতে গাঁয়ে কিছু মহিলা দেখলাম জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। জানতে পারলাম, যেসব বাড়িতে শৌচালয় নেই, দিনেরবেলায় সেইসব বাড়ির মহিলারা শৌচকার্য সারতে পারে না গাঁয়ে। তাই রাতেরবেলায় জঙ্গলে গিয়ে তাদের শৌচকার্য সারতে হয়। জেনে মনটা খুবই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।
Leave a Reply