করোনাহীন পৃথিবীতে সাতদিন
জিতেন নন্দী। মেটিয়াবুরুজ। ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০।#
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সেবক রোড ধরে এগোলে রাস্তায় পড়ে তিস্তা নদী। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ একটা নদী। আরও এগোনোর পর পথে পড়ে লিস নদী। স্থানীয় লোকে বলে লিসখোলা। চওড়া নদী খাত, অথচ একফোঁটাও জল নেই এখন। সাদা বিছানো পাথর দেখে বর্ষায় নদীর ভরা চেহারাটা অনুমান করা যায়। এটা পার হলেই শুরু হয়ে যায় এক বিপজ্জনক পথ। সেই পথ পেরিয়ে আরও নদীর দেখা মেলে — জুরেন্তি, রুমতিখোলা। পাহাড়ের ওপর থেকে ঝর্ণার জল নিয়ে এরা সকলেই মিলেছে তিস্তার সঙ্গে।
এখানে শান্ত পাহাড়ের বুকে এখন বুক কাঁপানো গর্জন মেশিনের। বড়ো বড়ো জেসিবি মেশিন দিয়ে পাহাড় কাটা হচ্ছে। দুপাশে হাজার হাজার বৃক্ষ উপড়ে ফেলা হচ্ছে প্রতিদিন। ট্রাকে বোঝাই হয়ে সেই কাটা গুঁড়িগুলো চলে যাচ্ছে শিলিগুড়ির দিকে। হাইওয়ে তৈরি হচ্ছে। লোকের মুখে জানতে পারি, এই হাইওয়ে যাবে কালিম্পঙ জেলার মধ্য দিয়ে সিকিম-সীমান্তে নাথু-লা পর্যন্ত। ভারত-চীন সীমান্তে যে গোলযোগের কথা আমরা গত কয়েক বছর ধরে শুনছি, সেখানে চীনের সঙ্গে সামরিক মোকাবিলা করার আয়োজনের অঙ্গ এই দীর্ঘ হাইওয়ে। পাকদণ্ডীর মাঝে মাঝেই সরকারি সাবধানবার্তা, ধসপ্রবণ পাহাড় এই বিপুল কর্মযজ্ঞে হয়ে উঠেছে আরও বিপদসংকুল। তবে স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে কিছু জানতে পারি না — সেন্ট্রাল থেকে দেশরক্ষার জন্য চার বছরের প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে, এ নিয়ে কে আর কী বলবে! এ তো যশোর রোড কিংবা কলকাতা শহরের উন্নয়নে গাছকাটা নয় যে পরিবেশকর্মীরা ছুটে আসবে!
এই অশান্তির পথটা পেরিয়ে আমরা পৌঁছাই অন্য এক পৃথিবীতে। ইয়েলবঙ, লঙরেপ, সমথার, কফের, চারখোল, রাটে, কম্মল, ফ্যান্টর, চুইখিম, ডারাগাঁও, নিমবঙ … একের পর এক পাহাড়ী গ্রাম, যেখানে করোনার আতঙ্ক এতটুকু নেই, কারও মুখে মাস্ক নেই। একজনও করোনায় মারা যায়নি এখানে। এখানে কাটিয়ে এলাম সাতটা দিন।
ইয়েলবঙ। এক ছোট্ট গ্রাম। মাত্র ৪৫-৫০ ঘর মানুষের বাস। গ্রামের নিচেই রুমতি নদী। এখানে ইলেকট্রিসিটি আছে বটে, কিন্তু প্রায় কারো ঘরেই টিভি নেই। বেশিরভাগ পরিবার ক্রিশ্চান। তাদের জন্য একটা রোমান ক্যাথলিক, আর একটা এলসিদাই প্রটেস্টান্ট চার্চ রয়েছে। পাঁচটা বৌদ্ধ পরিবার আছে, তারা ঘরেই উপাসনা করে। গ্রামে বাজার নেই, স্কুল নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। সেসবের জন্য লোকে যায় বরবট কিংবা বাঘরাকোটে। সব চাষি পরিবার। ধান, ভুট্টা, ডাল ফলে, কিন্তু মাসদুয়েকের বেশি তাতে চলে না। আর রয়েছে অজস্র ফুল আর ফলের গাছ। তাই সব ঘর থেকেই জোয়ান ছেলেরা চলে যায় চেন্নাই, বাঙালোর, কেরালায় রাঁধুনির কাজে। আর মেয়েরা যায় পার্লার কিংবা সেলুনে। লকডাউনের মাসদুয়েক পর এই ছেলেমেয়েরা গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হল। কিন্তু কেউ এখানে করোনার ভাইরাস সঙ্গে করে আনেনি। একজনও সংক্রামিত হয়নি। ট্রেনে বা প্লেনে ফেরার সময় যেটুকু টেস্ট হয়েছিল, ব্যস।
আর একটা গ্রাম চুইখিম। আকারে আর একটু বড়ো। শ-দুয়েক ঘর। এরা কেউ কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ। মন্দির একটা আছে। পাহাড়ের মাথায় একটা বৌদ্ধ উপাসনাগৃহ তৈরি হবে, সেখানে আপাতত বুদ্ধের একটা মূর্তি রয়েছে টিনের চালের নিচে। এখানে অবশ্য স্কুল আছে। দোকানপাটও সামান্য আছে। এখানে ইয়েলবঙের মতো অত ফলের গাছ নেই। তবে ঘরের পাশে বড়ো মাচার ওপর লতানে স্কোয়াশ ফলের ঝাড় রয়েছে। সবজি বলতে দুবেলাই স্কোয়াশ, সঙ্গে কেনা সামান্য আলু পেঁয়াজ। প্রত্যেক ঘরের লাগোয়া জমিতে দৌড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাল মুরগি। গরুও আছে। এদের মল মাটির সঙ্গে মিশে জমিকে উর্বর করে তুলেছে। কোথাও কোনো রাসায়নিক সার, বিষের আয়োজন নেই।
কিন্তু রাতের বেলায় নির্মীয়মাণ হাইওয়ে থেকে গ্রামে ঠাঁই নিচ্ছে দানবীয় জেসিবি মেশিনগুলো। লোকে জায়গা দিচ্ছে, সামান্য রোজগারও তাতে হচ্ছে। গ্রামের ছেলেরা সেই প্রকল্পে কিছু কাজও পাচ্ছে।
হাইওয়ের নতুন পথ বেয়েই কি আসবে নতুন ভাইরাস? গ্রামবাসীরা জানে না। তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই কারো।
Leave a Reply