শাহিনা পারভীন, মেটিয়াবুরুজ, ১৪ জুন#
আমাদের দুটো রাতের পরব হল শব-এ মেহরাজ এবং শব-এ বরাত। আরবি রজব মাসের ২৬ তারিখের দিনগত রাত শব-এ মেহরাজ এবং শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিনগত রাত শব-এ বরাত হিসেবে পালিত হয়। ইংরেজি ২০১৫ সালের মে মাসের ১৭ তারিখ ছিল শব-এ মেহরাজ আর জুন মাসের ৩ তারিখ ছিল শব-এ বরাত।
আমার ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি শব-এ মেহরাজ আর শব-এ বরাত, এই দুই রাতের মধ্যে শব-এ বরাতের রাত বেশ জাকজমকপূর্ণ হয় আমাদের এই গার্ডেনরীচ অঞ্চলে। এই রাত দুটি কেন পালন করা হয়, এ বিষয়ে মায়ের মুখে অনেক গল্প শুনেছি। ইসলাম ধর্মের দুই পবিত্র রাত এই দুটি। মা বলেন, এই রাতে ঠিকমতো মন দিয়ে ইবাদত করলে অনেক নেকি ও সাওয়াব পাওয়া যায় এবং মনের ইচ্ছাও পূরণ হয়। দুই পরবেই সারা রাত ধরে নফল নামাজ পড়া হয়, কুরান তেলায়াত করা হয় এবং ফজরের সাহেরি খেয়ে পরের দিন একটা নফল রোজা রাখার নিয়ম চলে আসছে। আমার মা সারা রাত জাগতে পারেন না, তাই অনেক সময় দুটো করে রোজা রাখেন। শব-এ মেহরাজের দিন অবশ্য কোনো বিশেষ রান্না হয় না। তবে মসজিদে বিরিয়ানি ও খিচুড়ি হয়। আমার আব্বু আর ভাই নামাজ পড়ে আসার সময় নিয়ে আসেন। তাবারুক হিসেবে আমরা সবাই মিলে খাই। মা বলেন, এই শব-এ মেহরাজের রাত হজরত মহম্মদ (সাঃ) আল্লার প্রেরিত বুররাখ নামক ঘোড়ায় চড়ে জিব্রাইল (আঃ) ফিরেস্তার সঙ্গে আল্লার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। সেইজন্য এই রাতটির ফজিলাত অনেক বেশি। আমরা যখন বড়ো হলাম, মায়ের সাথে আমরাও রোজা রাখতে শুরু করলাম।
শব-এ মেহরাজ একটু নীরবে নিঃশব্দেই পার হয়ে যায়। কিন্তু ছোটোবেলার শব-এ বরাতের কথা খুব মনে আছে। শব-এ বরাতের রাতে আতসবাজি করার জন্য আমরা কত আগে থেকে প্রস্তুতি নিতাম। ফুলঝুরি, ফুলতুবড়ি, রকেট, পটকা কিনে জমা করা হত। শব-এ বরাতের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বন্দুক দিয়ে চিটে বোম ফাটানোর ধুম পড়ে যেত। আমরা অবশ্য পাকা মেঝেতে রেখে পাথর ঠুকেও ফাটাতাম। সেই সময় প্রায় সবার পকেটে এক-দুই প্যাকেট চিটে বোম থাকতই। বাড়ির আশেপাশে অস্থায়ী বাজি বিক্রির মরশুম লেগে যেত। পাড়ায় ছেলেদের দেখতাম দূর থেকে অল্প দামে কিনে এনে পাড়ায় বেশি দামে বিক্রি করত। মা অবশ্য বারণ করতেন। বলতেন, শব-এ বরাত আসলে ইবাদত করার রাত। এই রাতে মৃত আত্মীয়স্বজন, পূর্বপুরুষদের এবং তামাম মুসলমান মৃত বান্দাদের জন্য দোয়া করতে হয়। তাঁদের গোনা মাফ করে দেওয়ার জন্য কবরের আজাব থেকে মুক্তির জন্য, সাওয়াবের জন্য, আত্মার শান্তির জন্য দোয়া চাইতে হয়। মা আমাদের ভয় দেখিয়ে বলতেন যে এই রাতে সমস্ত আত্মারা মুক্তি পায়। আর তাঁরা তাঁদের কাছের মানুষের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। কিন্তু যদি তাঁরা এসে দেখেন, আমরা এইসব করছি, তাঁদের জন্য দোয়া করছি না, তাহলে তাঁরা অনেক দুঃখ পাবেন। উনি বলতেন যে এইসব আতসবাজি করা উচিত নয়। তখন আমরা এত অবুঝ ছিলাম যে মায়ের বারণ ভালোই লাগত না। সবাই যা করছে, আমরাও তাই করতে চাইতাম। তবে এখন মায়ের মতো আমরাও ছোটোদের এসব না করতে বলি। ছোটোবেলার শব-এ বরাতের রাত আর এখনকার রাতের মধ্যে অনেক ফারাক এসে গেছে। তখন আমরা একসাথে পাড়ার সব মেয়েরা শাড়ি পরতাম, নামাজ পড়তাম। এখন আর সেসব নেই। মেয়েরা ঘরের মধ্যে মায়ের সাথেই হয়তো নামাজ পড়ে। ছেলেরা কিন্তু মসজিদে গিয়েই নামাজ পড়ে। তারা প্রত্যেকে শব-এ বরাতের রাতে তাদের মৃত আত্মীয়স্বজনের কবরে জিয়ারত করতে যায়। আমার ভাইও যায়। আমি অবশ্য মায়ের মতো রাত জাগতে পারি না। তবে পরের দিন আমি, মা আর ভাই রোজা করি। শব-এ মেহরাজ এবং শব-এ বরাতের রোজা যেহেতু নফল রোজা — না করলেও হবে — তাই বাবাকে কোনোসময় করতে দেখিনি।
শব-এ বরাতে অবশ্য একটা খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার আছে। রুটি, হালওয়া এবং পয়সা গরিবদের বিতরণ করা হয়। মায়ের মুখে শোনা, এই দিন হজরত মহম্মদ (সাঃ) হালওয়া রান্না করে খেয়েছিলেন এবং খাইয়েছিলেন। তাই হালওয়া রান্নার একটা প্রথা আছে। অনেকে অবশ্য সুজির হালওয়ার সাথে ছোলার ডালের হালওয়া, পরোটাও করে, যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী। আমার মায়ের হাতের ছোলার ডালের হালওয়া খাওয়ার জন্য আমরা এই দিনটার অপেক্ষায় থাকি। তবে এবছর মা কিছু করেননি। এসব করতে গেলে ভীষণ পরিশ্রম হয়। রাত জাগতে কষ্ট হয় বলে মা রোজা রেখেছিলেন ওইদিন।
ইদানীং অবশ্য শব-এ বরাতের চেহারাটা অনেক বদলে গেছে। বাড়ির গিন্নিরা হরেকরকমের রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হয় মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে অথবা নতুন বউমার প্রথম শব-এ বরাত, তাই খাওয়াতে হবে ইত্যাদি। আতসবাজির চেহারাটাও বড়ো আকার নিয়েছে। শব-এ বরাতের রাতে যদিও তেমন বাজির আওয়াজ শোনা যায় না। কিন্তু তার পরের দিন থেকে বিকট বিকট বোমার আওয়াজে কান মাথা ঝালাপালা। আগের সেই চিটে বোম, পটকার আওয়াজ আর প্রায় শোনাই যায় না। ফুলতুবড়ি, রকেট ইত্যাদি বাজির আধুনিকতা এতই বেড়েছে যে দূর থেকেও তার আলোর ঝলকানি আকাশে দেখতে পাওয়া যায়। আর বাতাসে বারুদের গন্ধ — মনে হয় দীপাবলী নামক আলোর উৎসবকেও হার মানিয়ে দিয়েছে।
Leave a Reply