৩ জুন, মিত্রা চ্যাটার্জি, বোলপুর, দারন্দা#
বোলপুর থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে গোপালনগর গ্রাম। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আশেপাশে লাগোয়া কিছু আদিবাসী গ্রাম। রায়পুরের রাজবাড়ির খাসতালুক ছিল একসময়। এখন ইলামবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে। সেই গোপালনগর গ্রামে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হয় ধর্মরাজের পুজো। গ্রামের অভ্যন্তরে প্রায় মধ্যস্থলেই রয়েছে প্রাচীন ধর্মরাজের মন্দির। মন্দিরের সামনে চারিপাশ খোলা নাটমন্দির। মন্দির সম্ভবত রাজ আমলেই রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি।
এই ধর্মরাজের পুজোকে কেন্দ্র করে বসে বিরাট গ্রামীণ মেলা। সমাগম হয় প্রচুর মানুষের। এই পুজো আর মেলাকে কেন্দ্র করে গোপালনগরের মানুষের বিশাল উত্তেজনা। মূল মন্দির থেকে ঠাকুরকে বার করে আনা হয় প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমা তিথির শুভ প্রাতে। ঢাক ঢোল বাজনা সহ ঠাকুরকে পুকুরে অবগাহন করিয়ে বসানো হয় নাটমন্দিরে এক বড়ো সিংহাসনে। সেই সিংহাসনে সাজানো থাকে অনেক ছোটো ছোটো মাটির সাদা ঘোড়া। অনেক সময় গ্রামের বটতলায় মানতের লাল হলুদ দড়ির সাথে ওইরকম পোড়ামাটির ঘোড়া সাজানো থাকে। প্রায়শই সেরকম আমাদের চোখে পড়ে। পুরোহিত আসেন পাশের চেল্লা গ্রাম থেকে তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে। প্রচুর ফলমূল, চালকলার নৈবেদ্য সাজানো হয় পিতলের গামলায় নাটমন্দিরের মেঝেতে। যজ্ঞের আয়োজনও থাকে। গ্রামের মেয়েপুরুষ সেই আয়োজনে ব্যস্ত থাকে। বৈধি পূজার পরিচিত আয়োজন। কিন্তু তার পাশাপাশি উৎসবের মূল সুরটা অন্যখানে। বাংলার অন্যান্য জায়গায় চৈত্রের সংক্রান্তিতে যে গাজনের উৎসব হয়, এখানেও সেই সুরে সেই আঙ্গিকেই হয় এই উৎসব। গ্রামের ব্রাত্যজনেরা এই উৎসবের অংশীদার। নিম্নবর্ণের মানুষেরা নানারকম দৈহিক কষ্ট, সহিষ্ণুতার বিচিত্র প্রক্রিয়ায় পুণ্য অর্জন করে থাকে একদিনের জন্য সন্ন্যাসী হয়ে। গাজনের সন্ন্যাসীদের মতো এখানেও সেই ব্রাত্যজনেদের মধ্যে কেউ কেউ মাসাধিক কাল নিরামিষ আহারের সাথে নানা সংযম পালনের মাধ্যমে সন্ন্যাসীর শক্তি অর্জন করে। এটাই স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস।
জ্যৈষ্ঠের তাপদাহকে উপেক্ষা করে শরীরের নানা জায়গায় কাঁটা বিঁধিয়ে আগুন জ্বালিয়ে অদ্ভুত সহ্যশক্তির পরিচয় দিয়ে থাকে নবীন সন্ন্যাসীরা। সবচেয়ে কঠিন যে প্রক্রিয়া তা হল, একটা তক্তায় অজস্র মোটা মোটা কাঁটা বিঁধানো থাকে। তাতে শুইয়ে দেওয়া হয় সেইরকম একজন সন্ন্যাসীকে। হিন্দু ধর্মের মূলস্রোতে যারা ব্রাত্য, সেদিনের জন্য এই সন্ন্যাসীরা হয়ে ওঠে শক্তির আধার। গ্রামের মানুষের কাছে তা অলৌকিক এক শক্তি। পুণ্যের আশায় সবাই ভিড় করে, মানত করে।
এরপর সেই মানুষটিকে চারিধার দিয়ে কলার ভেলা দিয়ে ঘিরে একটা কাপড় চাপা দেওয়া হয়। পুরো জিনিসটা একটা চাকার ওপরে রেখে অন্তত দশবারোজন মানুষ বাঁশের ওপর কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে তাকে ঘোরে, ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় এদিক থেকে ওদিক, সারা গ্রামময়। তাদের পায়ের পেশীর জোর খাটানো দেখলে বোঝা যায়, তাদের নিজের গতিতে তারা ঘোরে না, যেন এক মায়াবি শক্তি তাদের ওপর ভর করে!
অবশেষে এই বাহকেরা ফিরে আসে মূল মন্দিরে। মাটিতে রাখা হয় কাঁটা বিঁধানো তক্তাকে। মানুষটাকে যখন তুলে আনা হল, তখন তার অর্ধমৃত অবস্থা। সকলে মিলে বড়ো তালপাতার পাখার হাওয়া আর জল দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলে। ওই মানুষটির সম্মানে মেয়েরা বাতাসার হরির লুট দেয়।
ভাবতে অবাক লাগে আজও কী অদ্ভুত বিশ্বাসে গোটা গ্রাম শামিল হয় এই অনুষ্ঠানে। দিনরাত ঢাকের আওয়াজ উৎসবের মাত্রাকে ধরে রাখে টানটান। মন্দিরের সামনে ছাগবলিও চলে। চলে কীর্তন। অবশ্য যুবক-উদ্যোক্তাদের উৎসাহে বিকেলে বসে কবিগান আর বাউলের আসর, অর্কেস্ট্রাও। অগুনতি মানুষ নতুন সাজে আনন্দের কলরবে আসে মেলায়। তারা কেনাকাটা করে, নাগরদোলা চড়ে, খাবার কিনে খায়।
এক গ্রামের পর আরেক গ্রাম, তারপর আরও অনেক গ্রাম জুড়ে এই গ্রীষ্মে চলে ধর্মরাজের পুজো আর উৎসব।
Leave a Reply