অমিত মাহাতো, ১৪ আগস্ট#
জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় রাস্তার এখানে ওখানে জল জমেছে। বিশেষ করে বাস রাস্তার গায়ে যেখানে মাটি রয়েছে। মাটি ও ঘাম মাখা আদিবাসী মহিলাদের মুখগুলো দেখলাম বাসে আসার পথে। এই মহিলারা তো দল বেঁধে কাজ করতে ভালোবাসে, এবং এই কাজের থেকে ফেরার পথে ওদের গ্রাম শাল জঙ্গল ঘেরা বিলাশোল। দেখলাম, মেঘলা বিকেলের ম্লান আলোয় ওদের মুখের ঔজ্বল্য ও সারল্য এতটুকু খর্ব হয়নি। সিমেন্ট মশলা কুচি পাথর মাটি যাদের মাথার ওপর অবলীলায় চড়ে বসে তাদের মধ্যে কতখানি দরিদ্রতা আছে জানি না। তবে অবাক করল মহিলা পুরুষে কাজের মূল্যের আশমান জমিন ব্যবধানে। দুরকম মূল্যে নারী ও পুরুষের শ্রম বিক্রি হয়, একই সময়ের ব্যবধানে। বিশেষত আমি যখন বছর দুয়েক আগে ঝাড়গ্রামে ঠেকপ্রিন্ট নামে একটি ব্যক্তির প্রিন্টিং কারখানায় কাজ করতাম, সেখানেও দেখেছি মহিলা ও পুরুষের কাজের মজুরি সমান নয়। সেই ব্যবধান একই রকম আজও রয়েছে। এই বৈষম্য নিয়ে গ্রাম আর কতকাল থাকবে? জানি না সে মানসিকতা আদৌ পাল্টাবে কি না, বিশেষত কাজের ক্ষেত্রে। এইসব প্রসঙ্গ এসে মন ভারী হয়ে উঠল মানসদার মোটরসাইকেলে উঠে সোনামুখী শহরের ভেতর দিয়ে বর্ধমান রোডে উঠলাম। তারপর বেঁশে ব্রিজ, ক্যানাল পাড়, আদিবাসী গ্রাম, রেললাইন পেরিয়ে মাস্টারডাঙার মাঠ বরাবর বাঁদিকে শালবন রেখে গিয়ে উঠলাম মানসদার জঙ্গলের বাড়ি নাপিতের মাঠে। এর আধা ঘন্টার পরে সন্ধ্যের মুখে কলকাতা থেকে বাসে বেঁশে ব্রিজ, তারপর একই পথে পায়ে হেঁটে এই ডেরায় পৌঁছলো শ্রীমান ও শমীক। ক-দিনের অন্য জীবনে গা ভাসানোর মতলবে।
অন্ধকার রাতে চাঁদের আলো আর নক্ষত্ররাজি ও জোনাকিদের মধ্যে চারদিক ঘেরা শাল জঙ্গলের ভেতর মানসদার এই বাড়ি যে মাঠে, তা নাপিতের মাঠ হিসেবে পরিচিত। হয়তো কোনো নাপিতের এই মাঠ ছিল এক সময়। তারপর সেটা হয়ে যায় বুনো দাঁতাল হাতিদের প্রিয় আড্ডাস্থল। মানসদা যখন এই বাড়ি করে, তখনও একবার হাতির দলটি ভেঙে দিয়েছিল এই বাড়ি। মাঠের সীমানায় পরিখা খাল কাটায় সে উৎপাত বন্ধ হয়েছে আপাতত। রাত্রে মাঝে মাঝেই কারেন্ট চলে যায়। মোমের আলোয় আমি শমীক মানস শ্রীমান সহ এই বাড়ি দেখভাল যিনি করেন, সেই জ্ঞানেন্দ্র বারুইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই জায়গা নিয়ে। মানসদা জানালেন, বছর পঁচিশ আগে এইখানে একজন মাস্টার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছে সু-সংগঠক হিসেবে সুনাম ছিল তাঁর। মাস্টারডাঙার পাশের গ্রাম ধাদকিডাঙার আদিবাসীদের সাথে বিবাদের জেরে তিনি খুন হন। সেই থেকে এই গ্রামের নাম হয়ে যায় মাস্টারডাঙা। সেটি অবশ্য ধানসিমলা গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি গ্রাম।
জ্ঞানেন্দ্র বারুই জানালেন, তিনি এখানে বিয়ের সূত্রে রয়েছেন। আগে থাকতেন দুর্গাপুরের গোপালপুরে। পড়াশুনা করেননি। অল্প বয়সে কখনও করেছেন ট্রাকের খালাসির কাজ, বাসের হেল্পারি, এমনকী রিক্সাও টেনেছেন দুর্গাপুরে। বিয়ের পরদিনই উঠেছেন এই মাস্টারডাঙায়। শাশুড়ি অবশ্য কিছুটা চাষের জমি দিয়েছেন। সেই সূত্রে তাঁর পরিচিতি মাস্টারডাঙার জামাই হিসেবে। শুনলাম তাঁর মুখে অনেক কথাই। মাস্টারডাঙা গ্রামটি মূলত বাংলাদেশের উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের গ্রাম। আদিবাসী পরিবার সাকুল্যে চার পাঁচ ঘর। কিন্তু প্রথমে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের পরিবার ছিল চারটি। ফরেস্টের পক্ষ থেকে থাকার জায়গা ও পুনর্বাসন হিসেবে সেই চারটে পরিবার পায় ন-বিঘা করে জমি। সে জমিতে অবশ্য চাষ শুরু করতে সময় লেগেছে অনেকটাই। এখন চারটি পরিবার থেকে কুড়ি পঁচিশ ঘরের একটি গ্রাম।
বিয়ের পরে তিনি ফেরিওয়ালার কাজ করেছেন বছর পাঁচেক। গ্রামে গ্রামে জিনিস ফেরির জন্য তিনি মগরা থেকে আনতেন সেসব জিনিস কিনে। দশ টাকার তিনটি সাবান আনতে তিনি চলে যেতেন বেথুয়াডহরী সাবান ফ্যাক্টরিতে। ছেলেরা বিবাহিত। একজন শ্বশুরবাড়িতে উঠেছে। অন্যজন চেন্নাইয়ে মিস্ত্রির কাজ করে। ছোটো মেয়ে ফোন ব্যবহার করে। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন মাধ্যমিকের পরে। ছোটোবেলায় এক পা পোলিওতে আক্রান্ত হয় জ্ঞানেন্দ্রবাবুর। উনি যখন ছোটো, উনার বাবা চলে যান পিসির বাড়ি বাগুইহাটি (কলকাতা) জবরদখল কলোনিতে। মা মানুষ করেছেন কয়লা বিক্রি করে, ঝিয়ের কাজ করে। দুর্গাপুরের গোপালপুরে তাদের চারভাই-এর পাঁচকাঠা জমি রয়েছে। এখন তিনি লিজের মাধ্যমে অন্যের জমি নিয়ে করলা চাষ করেন।
Leave a Reply