অমিত মাহাতো, ঝাড়গ্রাম, ২৯ আগস্ট#
২০ জুন সকাল এগারোটা চল্লিশে মেদিনীপুর বাঁকুড়া লোকাল ট্রেনে উঠলাম। যাব সোনামুখী। আড়াই ঘন্টার ব্যবধানে ট্রেন পৌঁছোল বিষ্ণুপুরে। নেমে পড়লাম। তারপর স্টেশন থেকে বেরিয়ে অটোতে বাম দিক হয়ে ডানদিক তারপর আবার বামদিকে বাসস্ট্যান্ডের গোড়ায় নামিয়ে দিল। অবশ্য এ জায়গার নাম রসিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড। খাবার হোটেল দেখে ঢুকে পড়লাম। কুড়ি টাকা দিয়ে খেলাম ডাল ভাত সবজি। মোবাইলে দেখলাম পৌনে তিনটে বাজে। হোটেলওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এখান থেকে সোনামুখী যাওয়ার জন্য কোনো চিন্তা বা চাপ নেওয়ার দরকার নেই। বাস সবসময়। একটু উদ্বুদ্ধ হলাম।
শুনেছি প্রাচীন এই বিষ্ণুপুর শহর সংস্কৃতি জগতে রাজ আমল থেকে, বিশেষ করে গানবাজনার দিকে বিষ্ণুপুরী ঘরানার সুনাম বেশ জোরালো। যদুভট্টের নাম ও ঘরানা এই শহরের বেশ তুঙ্গে। বাসস্ট্যান্ডের বাইরে বেরিয়ে এলাম পশ্চিম দিকে। সরু গলির মতো রাস্তায় হাঁটা লাগালাম। বাঁদিকে ওষুধের দোকান। ডানদিকে গয়লাপাড়া বস্তি। দেখলাম ক-পা তফাতেই বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালের নবনির্মিত ভবন তৈরি হচ্ছে। এই সরু রাস্তা দিয়েই চারচাকা গাড়ি ঢুকছে বেরোচ্ছে। এর বাইরে মানুষের পা রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই। অন্য রাস্তা তো নেই। তা ছাড়া এই পথ এতই সরু যে অসাবধান হলেই ঘটনা ঘটে যাবে। প্রশাসন কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার অভিযোগ করে এক ওষুধ ব্যবসায়ী জানালেন, এই রাস্তায় প্রায় রোজই গাড়িতে মানুষে ধাক্কাধাক্কি ঘটে। চোখের সামনে দেখেও চুপ থাকতে হয় আমাদের। একই কথা অবশ্য রোগীর পরিবার পরিজনেরও। উল্টোদিকে গয়লাপাড়া বস্তি কী ভাবছে তা জানার কৌতুহল হলেও তা অবশ্য চেপে রাখলাম। উৎখাত হলে তো ওরাই প্রথম হবে।
আবার বাসস্ট্যান্ডে ফিরলাম। বর্ধমান রসুলপুর লাইনের একটি বাস বেরিয়ে গেল। এবার পূর্ব দিকে হাঁটা লাগালাম। স্টেডিয়াম চত্বরে জামাকাপড় আর ঘর গেরস্থালীর সামগ্রী নিয়ে মেলা বসেছে। পিচরাস্তার গায়ে উঠলাম। পূর্বমুখো হাঁটলাম কিছুটা, তারপর ফিরলাম। বাঁদিকে জেলখানা। ডানদিকে যদুভট্ট মঞ্চ ও অডিটোরিয়াম। অডিটোরিয়ামের চারপাশে সে কী ঠান্ডা। সম্প্রতি বিশেষ কেউ এসেছে বোঝা যাচ্ছে। ফিরলাম বাসস্ট্যান্ডে। বর্ধমানের বাস না পেয়ে দুর্গাপুরের বাসে উঠে বসলাম। মানসদাকে ফোন করলাম, কোথায় নামতে হবে জেনে নিলাম। বাস ছাড়ার পূর্বে আমার বাঁপাশের ফাঁকা সিটে বসল বছর তিরিশের এক যুবক। শমীকদার ফোন এল, ওরা পৌঁছোবে সন্ধ্যের মুখেই। বাস চলতে শুরু করল। সোনামুখী ভাড়া নিল চব্বিশ টাকা। এবং সময় নিল একঘন্টা। আমার বাঁপাশের তরুণটি আলাপ জমালেন। প্রথমে কাজকর্ম নিয়ে কথা হল। এই যেমন, কী করি, কী ভাবা হচ্ছে। আগামী দিনের পরিকল্পনা কী ইত্যাদি। জানালাম, ছোটো কাগজে লেখালেখি করি।
— আমি পলাশ মাঝি। বাড়ি শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে একটি গ্রামে। বাঁকুড়া সম্মিলনী কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন। এখন থাকি বিষ্ণুপুরের দ্বারিকাতে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, পলাশ সম্প্রতি বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। এবং দুটি বিধানসভা ছাতনা ও শালতোড়ার দায়িত্বে। পার্টির কাজেই বিষ্ণুপুরে আসা। প্রশ্ন করলাম, হঠাৎ বিজেপিতে কেন? নতুন সরকার তো উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে গোটা বাংলা জুড়ে।
— নিরাশ করবে মানুষকে। কলেজে টিএমসিপির হয়ে লড়েছিলাম। ছাত্রসংসদে দু-বছর ছিলাম। তারপর স্থানীয় স্তরে নেতৃত্ব নিয়ে তেমন কিছু করা যাচ্ছিল না, তাই বেরিয়ে গেলাম। এবং এই জায়গায় এসেছি। আসলে কী জানেন, সন্ন্যাসি তো হতে পারব না। প্রশ্ন করলাম, এখানেও যদি স্বপ্ন ভেঙে যায়? তখন বিকল্প কিছু ভাবব। আমি প্রশ্ন করলাম, বিকল্প বলতে? ও জানাল, ছোটো স্তরে কিছু করার চেষ্টা করব। এই যেমন কিছু লোককে নিয়ে সেলফ হেল্প-এর চেষ্টা। যাই করি, সংস্পর্শ এড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। পলাশ মাঝির মুখে উঠে এল আরেকটি চাঞ্চল্যকর খবর। প্রাইমারি টেট নিয়ে। টোপ দিচ্ছে একটি বেকার ছেলেকে। এবং প্রাইমারি চাকরি বিকোচ্ছে সাত লাখ টাকা দিয়ে। যার টাকা তার চাকরি। একটি চক্র স্থানীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে এই কাজ করছে। তা নাহলে জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছে যুবকটির পরিবার। ঘটনাটি কতটা সত্যি বা মিথ্যে তা অবশ্য জানি না। ওর কাছেই শুনলাম। সত্যি হলে যুব সম্প্রদায় কেনই বা আস্থাভাজন হবে নৈতিকতায়? বাস এবার দাঁড়ালো দ্বারিকা স্টপেজে। পলাশ মাঝি নামল।
এবং উঠল কাজের মেয়েদের পাঁচজনের একটি দল। সকলেই আদিবাসী। স্থানীয় ফ্যাক্টরিতে কনস্ট্রাকশনের কাজ করে ওরা। একজন আমার পাশে বসলেন। ওদের দলটি নামবে তিলাশোল নামের গ্রামে। পাশে বসা মহিলাকে প্রশ্ন করলাম, কখন কাজে যোগ দাও? উনি জানালেন, সকাল সাতটা। ছুটি অবশ্য তিনটার সময়। কত করে রেট দেয়? মেয়েদের একশো ষাট টাকা, ছেলেদের দুশো দশ। কী কাজ করো? মাথায় নিয়ে বই। ওরা মূলত নির্মাণ শ্রমিক। এবার বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। এবং বাস ছুটে চলল, দ্বারিকা ছেড়ে কাঁচিলা রাধানগর গ্রাম পঞ্চায়েত জয়রামপুর তিলাশোল। তিলাশোলে কাজের দলটি নেমে গেল। ওখান থেকে শুরু হল শালবন। বনের শেষে গ্রাম। বলরামপুর। মানিকবাজার। কৃষ্ণবাটি। পাথরমোড়া। তারপর আবার শালবন। শালবনের গায়ে ছোট্ট গ্রাম। বুড়িআঙারি। কোচাডিহি। কল্যাণপুর। আবার জঙ্গল। জঙ্গলের শেষ চূড়ামণিপুর। সোনামুখী কলেজ। রেললাইন। বিডিও অফিস।
নেমে পড়লাম।
Leave a Reply