কাজল মুখার্জি, কলকাতা, ১৫ জুলাই#
ছবিটি শুরু হল, পর্দা অন্ধকার। একটা সংবাদের সোচ্চার পাঠ। আমরা শুনতে থাকি, ‘সারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কটের ধাক্কা কলকাতা শহরে এসে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রগুলি থেকে কর্মীসংকোচনে প্রচুর কর্মী ছাঁটাই হয়েছে, ছাঁটাই কর্মীদের বিক্ষোভ চলছে, পর্দার আলো এসে পড়ছে। এই শহরে সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ছে।
ছবির শুরুতেই যে সংবাদের টুকরোর সোচ্চার ঘোষণা তারপর দীর্ঘ সময় ছবিটি নিঃশব্দ নয় কিন্তু নির্বাক চলতে থাকে। ছবির সময় যখন সকাল থেকে সন্ধ্যার দিকে ঢলে পড়ে, তখন আবার এক বক্তৃতার টুকরো আমরা শুনতে পাই — ‘দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকার জন্য এক বন্ধ কারখানার শ্রমিক অনাহারে, অচিকিৎসায় মারা গেছে। বক্তৃতাটিতে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে, পুঁজির এই অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান রাখে। ছবিটি আবার নির্বাক হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর এক মিছিলের স্লোগানের আওয়াজ আমরা শুনি — পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে দিকে দিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক এই বিশ্বাসের জোরালো কণ্ঠ থেকে। এই তিনটি মুহূর্ত, শুধুমাত্র এই তিনটি মুহূর্তেই ছবিতে কথা ফুটে উঠছে। আর এই মুহূর্তগুলিই যেন তৈরি করে দেয় ছবিটির একটি রাজনৈতিক ভাষ্য।
সকালের কলকাতার সানাইয়ের আওয়াজ দিয়ে যে সকাল শুরু পরেরদিন আরেক সকালের সানাইয়ের আওয়াজ দিয়ে ছবিটি শেষ হয়। একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত রচনা করে। এই দুই সকালের মাঝখানে একটি ছেলে আরেকটি মেয়ের বেঁচে থাকার বৃত্তান্ত ছেলেটি নিয়ে ছবিটি নির্মিত হয়। এই ছেলেটি আর মেয়েটি স্বামী স্ত্রী। ছেলেটি তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রের ছাঁটাই হওয়া কর্মী এরকম ভাবনায় কোনো সমস্যা তৈরি হয় না যদিও ছবিটিতে তার উল্লেখ নেই। মেয়েটি উত্তর কলকাতার একটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির পর গলি পেরিয়ে ট্রাম ধরে, বাস ধরে অফিসে যায়। ছেলেটি একা হয়ে যায়, একা একা সে বসে থাকে, ব্যাঙ্কে যায়, বাজার করে, চান করে, পুজোর তাকে ধূপ জ্বালে। নিজের আর বউয়ের ছেড়ে দেওয়া কাপড় শুকোতে দেয়। খায়। ঘুমিয়ে পড়ে। মিস্ কল-এ ঘুম থেকে জাগে। ছেঁড়া প্যান্ট খাটে ঝুলিয়ে দেয়, নতুন প্যান্ট পরে, জামা গায় দেয়, সাইকেল নেয়, সাইকেলে করে বেরিয়ে পড়ে, একটা প্রেসে কাজ শুরু করে তখন শহরে রাত অন্ধকার। মেয়েটি অফিসে কাজ করে। অফিস ছুটি হয়। শূন্য ঘরে ঢোকে। ধীরে ধীরে কাজ শুরু করে। স্বামীর ছেঁড়া প্যান্ট সেলাই করে দেয়। বাসন মাজে। ফ্রিজ খুলে খাবার বের করে, খাবার খায়, শুয়ে পরে। রাত গভীর হতে থাকে। নিদ্রাহীনতা আর নিদ্রার মধ্যে মেয়েটির রাত ক্রমশই সকাল হয়। মিস্ কলে জেগে উঠে, রান্না করে, ছেলেটির জন্য খাবার রেখে দেয়, নিজের জন্য নেয়। ভোরের আলো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ছেলেটির প্রেস থেকে ছুটি মেলে। প্রাণপণে সাইকেল চালাতে চালাতে পৌঁছে যায় ঘরে। ঘরে প্রবেশ করে। পর্দার রঙীন আলো বদলে সাদা কালো হয়ে যায়। শহরটা কোথায় হারিয়ে যায়। ছেলেটি খাটে এসে বসে। এক পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝখানে পাতা খাটে ছেলেটি আর মেয়েটি বসে থাকে একটাই মুহূর্ত, মেয়েটির অফিসে যাওয়া আর ছেলেটির অফিস থেকে আসার মাঝে এক ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত তৈরি হয়। মেয়েটি ঘড়ি দেখে, সময় তো আর নাই — মেয়েটি এক কাপ চা এগিয়ে দেয় ছেলেটিকে। কপালের টিপটা মেয়েটি লাগিয়ে নেয়। শাড়ির আঁচলটা সেফটিপিন দিয়ে লাগাতে ছেলেটি এগিয়ে আসে, ছেলেটির হাতে সেফটিপিন, পরম মমতায় আঁচলটা লাগিয়ে দেয়। ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত শেষ হয়, মেয়েটি বেরিয়ে পড়ে, মুখে একটা অস্ফুট হাসি। আস্তে আস্তে গলির এক অনৈসর্গিক কুয়াশায় ঢেকে যায় মেয়েটির অবয়ব। ছেলেটি জানলায় দাঁড়িয়ে দেখে। দেখতে থাকে। মেয়েটিকে দেখা যায় না। ছেলেটির মুখে সেই অস্ফুট হাসি, সানাই বেজে ওঠে।
পুঁজি যখন বলে, টাইম ইজ মানি। সময়ই টাকা। খুব দ্রুত খুব দ্রুত সবকিছু সারতে হবে। এই ছবিটি যেন পুঁজির এই মন্ত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। দ্রুত কাট, একের পর এক শট, দ্রুতগতিতে ঘটনার পেছনে পেছনে দৌড়ানো। দর্শকদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ওঠে ছবির বেগ-এ। যত গতি, ততই আধুনিক। গতির আরেক নামই আধুনিকতা। এই ছবিটি এই আধুনিকতাকে অস্বীকার করেছে।
আমরা দেখি মেয়েটা হাঁটছে তো হাঁটছে। ছেলেটি বসে আছে তো বসেই আছে। কাপড় কাচার বালতি ফেনায় ভরে যাচ্ছে। ডাল, চাল ভর্তি হয়ে চলেছেই শিশিতে শিশিতে। এই শহরের দিগন্তরেখা থেকে সূর্য কীভাবে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামে শহরের অলিগলিতে। সন্ধ্যার আকাশে পাখিরা ফিরে আসতে থাকে। ডানা ঝাপটায়, ডানা ঝাপটায় সন্ধ্যার আগমনকে যেন নমস্কার করে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ধীরগতি, একেকটা মুহূর্ত কীভাবে মহাকাশে মিশে যাচ্ছে আমরা চোখ, কান দিয়ে তা উপলব্ধি করি।
চোখা চোখা সংলাপে ছবির গতিকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসের বদলে এক নির্বাক মুহূর্তমালা তৈরি করেন পরিচালক। নির্বাক চলচ্চিত্র এর আগেও হয়েছে — কিন্তু সে তো অনেকটা গিমিকই। এই ছবিতে, এই যে পুঁজি এই ছেলেটিকে মেয়েটিকে বাধ্য করেছে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা বেছে নিতে যাতে তাদের মধ্যে সংযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মানুষের সংযোগহীনতা মানেই তো নির্বাক হয়ে যাওয়া। নির্বাক ছবিটি তাই কখনও গিমিক থাকে না, হয়ে ওঠে প্রতিদিনকার বাধ্যতামূলক সংযোগহীনতা। এই সংযোগহীনতা কোনো প্রেমহীন সম্পর্ক টেনে চলার যন্ত্রণা নয়। সন্দেহের বিষবাষ্পে ঢেকে যাওয়া আত্মার বেদনা নয়। পুঁজির এক চাপিয়ে দেওয়া যন্ত্রণার পরিস্থিতির দাবি থেকে উঠে আসা নির্বাক চলচ্চিত্রটি ভরে উঠছে কত শব্দে, কত টুকরো টুকরো আওয়াজে, সমস্ত ছবিটিকেই যেন সবাক করে তোলে। এই নীরব, নিঃসঙ্গ মুহূর্ত ভরে ওঠে ‘মোর ঘুম ঘোরে’, আর গীতা দত্তর ‘তুমি যে আমার’, ‘বাঁকাচাঁদ’-এর গানের ইন্দ্রজালে, প্রেমের নিবিড় ছোঁয়ায়।
একদিকে টাকার পেছনে দৌড়ানো, আরেকদিকে টিঁকে থাকার জন্য পুঁজির যাঁতায় পিষ্ট হতে থাকা। আত্মাহীন এক মানবসমাজ। ভালোবাসা হারিয়ে যায় সংযোগহীনতায়। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ ছবিটি এই ভালোবাসাহীনতার মাঝখানে প্রতিষ্ঠা করে ভালোবাসার সম্পর্ককে। দুটি হৃদয়ের সহমর্মীতায় যে সানাই বেজে ওঠে ছবি জুড়ে তাই যেন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ভাষ্য। মেফিস্টো যেন সকালের আলোয় মাথা নিচু করে থাকে পরাজয়ের গ্লানিতে — দুটি আত্মা সে কিনে নিতে পারেনি। আমরাও বলি, ‘জয় হোক ভালোবাসার’।
Leave a Reply