সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ২৮ এপ্রিল#
কেন্দ্রীয় সরকারের চিট ফান্ড নিয়ে দু’টি আইন আছে। একটি হল ১৯৭৮ সালের প্রাইজ চিট ও অর্থ সঞ্চালনা স্কিম নিষিদ্ধকরণ আইন, অপরটি হল চিট আইন ১৯৮২। এর মধ্যে ১৯৭৮ সালের আইনে সরকারি ছাড়া অন্যান্য প্রাইজ চিট নিষিদ্ধ — একথা সরাসরি বলা আছে। এমনকি এই আইনে প্রাইজ চিট বা অর্থ সঞ্চালনা স্কিমের বিজ্ঞাপন যদি কোনও প্রকাশনা বা মিডিয়া ছাপে, তবে সেই প্রকাশনা বা সংবাদপত্রকে বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া আছে রাজ্য সরকারকে। পশ্চিমবঙ্গে আনন্দবাজার, বর্তমান থেকে শুরু করে প্রায় সবকটি বড়ো দৈনিক প্রিন্ট মিডিয়া এবং এবিপি /স্টার আনন্দ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রায় সমস্ত টিভি চ্যানেল একাধিকবার বেআইনি বলে অভিযুক্ত ৭৩ টি অর্থ লগ্নী সংস্থাগুলির মধ্যে একাধিক সংস্থার বিজ্ঞাপন ছেপেছে। ১৯৭৮ সালের আইন অনুযায়ী রাজ্য সরকার চাইলে সেগুলিকেও বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
১৯৭৮ সালের আইনে প্রাইজ চিট এবং মানি সার্কুলেশন স্কিম থেকে চিরাচরিত চিট-কে আলাদা করা হয়েছে। চিরাচরিত চিট-এ কয়েকজন মিলে টাকা জমিয়ে নিজেদের মধ্যে সেই টাকা বেশি-কম ভাগ-বাঁটোয়ারা করা যায়, ওই ভাগ বাঁটোয়ারা পরিচালনা করার জন্য কিছু কমিশনপ্রাপ্ত লোকও থাকতে পারে। আর প্রাইজ চিটে কোনও তৃতীয় ব্যক্তি প্রোমোটার বা দালাল হিসেবে আসে, ওই চিরাচরিত চিটের সুবিধার কথা বলে গ্রাহক বানিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা তোলে, এবং নির্দিষ্ট সময় পরে কিছু গ্রাহককে সুদ বা প্রাইজ দেয়, আর অন্য একটি অংশের গ্রাহককে কেবল তার আসল জমা-টা ফেরত দেয়, কোনও সুদ বা প্রাইজ দেয় না। সোজা কথায় চিটের নামে সে নিজের অস্বাভাবিক রোজগারের ফন্দি করে। ১৯৭৮ সালের আইনে চিরাচরিত চিট নিয়ে কিছু না বলা হলেও, প্রাইজ চিট এবং অর্থ সঞ্চালনা স্কিম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
আপাতত এই আইনে কী কী আছে তা একবার দেখা যাক। মনে রাখা দরকার, সম্প্রতি ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডি সুব্বারাও প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘১৯৭৮ সালের চিট আইনে অর্থ সঞ্চালনা স্কিম নিষিদ্ধ। যদি রাজ্য সরকারগুলি চায় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তবে রাজ্য সরকারের এই আইনের বলে পূর্ণ ক্ষমতা আছে।’
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘দ্য প্রাইজ চিট অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন স্কিমস (ব্যানিং) অ্যাক্ট, ১৯৭৮’ (মূল ইংরেজি বয়ান এখানে)
- আইনের ২ নং ধারায় চিট-এর সংজ্ঞা দেওয়া আছে : ‘কনভেনশনাল চিট’ বা চিরাচরিত চিট, যাকে চিট, চিট ফান্ড, কুরি বা অন্য কোনও নামে ডাকা হয়, তাতে একজন অন্য কিছু লোকের সঙ্গে মিলে একটা বোঝাপড়ায় আসে, যাতে প্রত্যেকে একটা পরিমাণ টাকা দেবে (বা দানাশস্য দেবে) ইনস্টলমেন্টে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। বিনিময়ে এই প্রত্যেক গ্রাহক টেন্ডার বা নিলাম বা লটারি অথবা অন্য কোনও ব্যবস্থার মাধ্যমে সুযোগ পাবে মোট জমার মধ্যে থেকে একটা পরিমাণ পুরষ্কার অর্থ (প্রাইজ অ্যামাউন্ট) পাবার, এবং ওই অর্থ তার প্রদেয় ইনস্টলমেন্ট থেকে বিয়োগ হবে।
‘মানি সার্কুলশন স্কিম’ (অর্থ সঞ্চালনা স্কিম) মানে হল কোনও স্কিম, তা সে যে নামেরই হোক না কেন, তাতে সহজে অর্থ আমদানির কথা বলা আছে। অথবা কোনও অর্থ বা মূল্যবান জিনিসপত্রাদি রেখে সদস্য হয়ে, তারপর আরও কিছু সদস্য তৈরি করতে পারলে অনেক বেশি অর্থ আমদানির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, তা সে অর্থ ঐ নতুন হওয়া সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির টাকা বা ইনস্টলমেন্ট থেকে আসুক বা না আসুক।
‘প্রাইজ চিট’ মানে হলো, কোনও একজন প্রোমোটার না ফোরম্যান বা এজেন্ট বা যাই হোক, সে কোনও বন্দোবস্তের মাধ্যেমে অন্যদের কাছ থেকে একলপ্তে অনেকটা টাকা বা ইনস্টলমেন্টে টাকা তুলে তার পুরোটা বা একটা অংশ বিনিয়োগ করবে, লটারি বা অন্য কোনও ব্যবস্থার মাধ্যমে তা অন্য কিছু গ্রাহকের মধ্যে প্রাইজ হিসেবে বন্টন করবে, বা নির্দিষ্ট সময় শেষে কিছু বোনাস বা প্রিমিয়াম বা ইন্টারেস্ট দেবে। আর যারা এই প্রাইজ পেল না, সেইসব গ্রাহকদের কোনও সুদ বা প্রাইজ কিছুই দেবে না, শুধু আসল বা তার কিছু ইনস্টলমেন্ট ফেরত দেবে। - আইনের ৩ নং এবং ৪ নং ধারায় বলা আছে, এই প্রাইজ চিট বা মানি সার্কুলেশন স্কিম-এ সদস্য বা অংশগ্রহণকারী হিসেবে ঢোকা নিষিদ্ধ। কেউ প্রাইজ চিট বা মানি সার্কুলেশন স্কিমের প্রচার করতে পারবে না। অন্যথায় তার, তিন বছর পর্যন্ত জেল বা/এবং পাঁচ হাজার টাকা অবদি জরিমানা হতে পারে। এই সাজা কখনওই একবছরের কম বা এক হাজার টাকার কম হবে না।
- আইনের ৫ নং ধারায় বলা আছে, কেউ এই প্রাইজ চিট বা মানি সার্কুলেশন স্কিমের সঙ্গে জড়িত থেকে টিকিট, কুপন বা অন্যান্য তথ্যাদি ছাপালে, বিজ্ঞাপিত করলে বা করার চেষ্টা করলে বা অন্য কাউকে দিয়ে এসব করালে বা সহায়তা করলে ২ বছর পর্যন্ত জেল বা/এবং ২ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
- আইনের ৬ নং ধারায় বলা আছে, কোনও কোম্পানি যদি এই অপরাধ করে, তাহলে সেই কোম্পানির যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের এবং কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
- আইনের ৭ নং ধারায় বলা আছে, এই অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে তল্লাশি চালানো এবং বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রয়েছে থানার ওসির বা রাজ্য সরকারের নিযুক্ত অফিসারের, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে। গ্রেপ্তারি এবং তথ্যাদি বাজেয়াপ্ত করারও অধিকার রয়েছে।
- আইনের ৮ নং ধারায় বলা আছে, প্রাইজ চিট বা মানি সার্কুলেশন স্কিমের প্রকাশনা বা সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করা হবে। যদি কোনও সংবাদপ্ত্র বা অন্যান্য প্রকাশনা এই প্রাইজ চিট বা মানি সার্কুলেশন স্কিমকে প্রোমোট করে কোনও প্রকাশনা ছাপে, বিজ্ঞাপন ছাপে — তবে রাজ্য সরকার অফিসিয়াল গেজেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই প্রকাশনা বা সংবাদপত্রটিকে বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
- আইনের ৯ নং ধারায় বলা আছে, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এই অপরাধের বিচার হবে।
- আইনের ১১ নং ধারায় বলা আছে, এই আইন প্রযোজ্য নয় কিছু প্রাইজ চিট বা মানি সার্কুলেশন স্কিমের জন্য : রাজ্য সরকার, রাজ্য সরকারের কোনও দফতর, রাজ্য সরকারের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন কোনও কোম্পানি যারা কেবল চিটের ব্যবসাই করে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বীকৃত কোনও রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক বা গ্রামীন ব্যাঙ্ক, রাজ্য সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক স্বীকৃত কোনও দাতব্য সংস্থা বা শিক্ষামূলক সংস্থা।
- আইনের ১২ নং ধারায় বলা আছে, এই আইন চালুর সময় কেউ যদি কোনও চিট চালায়, তাহলে রাজ্য সরকার তাকে গুটিয়ে ফেলার জন্য সর্বোচ্চ দু-বছর সময় দিতে পারে।
- আইনের ১৩ নং ধারায় বলা আছে, রাজ্য সরকার প্রয়োজনে এই আইন লাগু করার জন্য নিয়ম তৈরি করতে পারে।
Leave a Reply