মণীষা চৌধুরী, কোচবিহার ৮ই জানুয়ারী,২০১৬#
নতুন বছরের শুরুতেই জানুয়ারী মাসের ৯ ও ১০ তারিখে কোচবিহারের ‘আনন্দম কালচারাল সেন্টারের’ উদ্যোগে স্থানীয় রবীন্দ্রভবন মঞ্চে বসছে আন্তর্জাতিক মুখাভিনয় উৎসব। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে এই ‘আনন্দমের’ উদ্যোগেই কোচবিহারে শেষবার আন্তর্জাতিক মুখাভিনয় উৎসবের আসর বসেছিল। সেবার কোরিয়া ও জাপান থেকে শিল্পীরা এসেছিলেন। এবারে ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম হলেন পদ্মশ্রী নিরঞ্জন গোস্বামী, যিনি শুধুমাত্র একজন মুখাভিনয় শিল্পী নন, মুখাভিনয় বা মাইম শিল্পের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন। তিনি ছাড়াও কোলকাতা থেকে আসছেন শ্রীকল্পতরু গুহ, শ্রীরতন চক্রবর্ত্তী, আছেন জলপাইগুড়ির শ্রীসব্যসাচী দত্ত। এছড়া রাজস্থান থেকে আসছেন আসিফ শেরখান, আসাম থেকে শ্রী প্রাঞ্জল গগৈ, শ্রীমুকুন্দনাথ এবং প্রণবজ্যোতি হিরু। বাংলাদেশ থেকে আসছেন রেজওয়ান রাজন এবং শ্রীলঙ্কা থেকে আসছেন কৃষ্ণন্থা জয়াবাহু।
মূলধারার শিল্পচর্চা বিশেষত নাটক বা সিনেমাতে মুখাভিনয় মিশে থাকে কিন্তু মাইম বলতে যে ধারাটিকে বোঝান হয় সেটি আমাদের দেশে এককভাবে এখনও সেভাবে জনপ্রিয় নয়।কিন্তু তাতে কোনও পরোয়া নেই ‘আনন্দমের’। এই সংস্থার কর্ণধার শ্রী শঙ্কর দত্তগুপ্ত ছিলেন মূলত পদ্মশ্রী যোগের দত্তের ছাত্র। যোগেশবাবু ওনার কাছ থেকে কোনও সন্মানদক্ষিণা নিতেন না তাই শঙ্করবাবুও ঠিক করেছিলেন – কোচবিহারে তাদের নিয়েই কাজ করবেন যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে মাইমের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে প্রায় হাজারের উপর মঞ্চ প্রদর্শনী করে ফেলেছে শঙ্করবাবু ও তাঁর সংস্থা। তাঁর সাথে কথাপ্রসঙ্গে জানা গেল মাইম(mime) শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন গ্রীক শব্দ মাইমোস(mimos) থেকে । যার আভিধানিক অর্থ – ‘নকল করা’। যদিও আমরা এখন মাইম বলতে যা বুঝি সেটা এক বিশেষ ধরনের শিল্পচর্চা – যেটা গত ১০০ বছরে ফ্রান্সে শুরু হয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষার মধ্যে দিয়ে উন্নততর হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই, যে কোনও ধরনের নাটকে মুখাভিনয়ের ব্যবহার হয়ে আসছে। আমাদের দেশে যেটা দেখি সেটা হল Oriental Mime. মাইমের এই ধারাটি সম্পূর্ণ এশিয়া মহাদেশে বিশেষ করে চীন ও জাপানে চর্চিত ও প্রদর্শিত হয়। অঙ্গসঞ্চালন ও মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে বিভিন্ন লোককথা বর্ণনা করা হয়। কিছু অভিনয় খুবই হাস্যরসাত্মক আবার কিছু প্রযোজনায় প্রায় জিমন্যাস্টিকের মত অঙ্গ সঞ্চালন দেখতে পাওয়া যায়। মাইমে যখন গল্প বলা হয় তখন নড়াচড়া খুবই ধীর ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় ( Noh Theater, Japan) আবার ইটালিয়ান মাইম মূলত হাস্যরসাত্মক। দুমদাম পরে যাওয়া, মারপিট, পেছন থেকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া – মূলত এগুলিই ইটালিয়ান মাইমের অঙ্গ। আমরা সার্কাসে জোকারদের যেভাবে হাসাতে দেখি সেটাই ইটালিয়ান মাইমের একটি রূপ, যেখানে গল্পটি গুরুত্ত্বপূ্র্ণ নয় – হাস্যকর চরিত্রগুলি বেশী গুরুত্ত্ব পায়।
সবচেয়ে জটিল হল ফরাসী মাইম। একজন শিল্পীকে হাজার রকমের অঙ্গসঞ্চালন শিখতে হয়। এখানে একটা গল্প বলা হয় ঠিকই কিন্তু পুরোপুরি রূপক অর্থে। যা দর্শকদের মনের ভেতরে ঢুকে তাদের কল্পনাশক্তি বা আবেগ উস্কে দিয়ে অভিনয়ের সাথে একাত্ম করে নেয়, দর্শকরা অভিনেতাদের জায়গায় নিজেদের কল্পনা করতে পারেন। ইটালিয়ান ও ফরাসী মাইমের দুরন্ত সমন্বয় ঘটিয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত হয়েছেন চার্লি চ্যাপলিন।
আনন্দমের আর এক শিল্পী রিম্পি মজুমদারের কথায় “বেশীরভাগ জিনিস সৃষ্টি হয় ভালোলাগা থেকে।আমি হয়তো ছোট থেকে মাইম দেখিনি এবং আমার এ সম্পর্কে কোনও ধারনাই ছিল না। কিন্তু নাটকের থেকে আমি মাইমটাই বেশী দেখতাম এবং আমার খুব ভালো লাগত। সেই দেখতে দেখতেই আমার মাইমের প্রতি ভালোলাগা জন্মাল। মাইম এখনও মফস্বলে জনপ্রিয় না এটা ঠিকই কিন্তু ধীরে ধীরে যে এর প্রতি দর্শকের আগ্রহ বাড়ছে না এমনটাও নয়। উৎসাহ বাড়ছে। একটা ধারনা জন্মাচ্ছে, আমরা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ভাল Feedback পাচ্ছি। আমি আশাবাদী”।
Leave a Reply