বিকর্ণ, কোচবিহার, ২৯ জুলাই#
গতবছর সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা, দিদির রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে প্যাথলজিকাল ল্যাবোরেটরি থেকে বেরিয়েছি, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অস্বাভাবিক কম, পরদিনই হাসপাতালে ভর্তি করে রক্ত দিতে হবে। ল্যাব থেকে বেরিয়েই বাবাকে ফোন করলাম :
-হ্যালো
-হ্যালো
-হিমোগ্লোবিন খুব কম, ম্যাডাম বলেছেন কালকেই হাসপাতালে ভর্তি করে রক্ত দিতে হবে।
-হিমোগ্লোবিন খুব কম, ম্যাডাম বলেছেন কালকেই হাসপাতালে ভর্তি করে রক্ত দিতে হবে।
-আরে কি ব্যাপার? কী বলছ?
-আরে কি ব্যাপার? কী বলছ?
প্রথমে ভেবেছিলাম বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? আমি যা বলছি সেটাই আবার বলছে? পরে বুঝলাম ওটা আমার নিজেরই গলা, আমি যেটা বলছি সেটাই ২ সেকেন্ড পর আবার আমার কাছেই ফিরে আসছে। টাকা খরচা করে নিজের গলা শোনার মতো বিলাসিতা আমার নেই। বিশেষ করে যখন ওইরকম পরিস্থিতি। আরও দু-বার ফোন করলাম, প্রথমবার আগের মতোই ঘটনা ঘটল, দ্বিতীয়বার ফোন রিসিভ হওয়ার পর কোনো কথাই শোনা গেল না, কিন্তু কলচার্জ হিসেবে টাকা কাটা গেল। বিপদের সময়, তার ওপর এইরকম পরিষেবা, মেজাজ গেল গরম হয়ে, কিন্তু ওই গরম হওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। ইচ্ছে করছিল টান মেরে ছুঁড়ে ফেলতে — কিন্তু হ্যান্ডসেটের দোষ কি? হ্যাঁ আমি একজন বিএসএনএল-এর প্রিপেইড মোবাইল গ্রাহক। দেশের বৃহত্তম (তাদের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী) সরকারি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমি গতকাল পর্যন্ত এরকম পরিষেবাই পেয়ে আসছিলাম। আজ থেকে সেটা বন্ধ হয়েছে — না হঠাৎ করে পরিষেবা ভালো হয়ে যাওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। আমি বিএসএনএল ত্যাগ করে অন্য কোম্পানির নতুন একটা সংযোগ নিয়েছি আজ থেকে।
কোচবিহারে যখন প্রথম মোবাইল পরিষেবা চালু হল, তখন সাগরদীঘির পারে ভোর ৪টে থেকে লোকে লাইন দিত বিএসএনএল-এর সিমকার্ড নেওয়ার জন্যে। আমার তখন মোবাইল ফোন নেই, দরকারও ছিল না। ভিড় আর আকুতি দেখে ভাবতাম, এইরকম মারকাটারি অবস্থা যখন, তাহলে মনে হয় দুর্দান্ত পরিষেবার সাথে সাথে খরচাও কম হবে। পরে ২০০৫ সাল নাগাদ আমাকে বাড়ির থেকে একটা মোবাইল ফোন দেওয়া হল — ভবঘুরে জীবনের গতিবিধি জানার জন্যেই সম্ভবত। প্রথমে বিএসএনএল-ই নিলাম। যদিও তখন আরও ২-১ টা কোম্পানি চলে এসেছে। সিম পাওয়াটা সেরকম ঝামেলার ব্যাপার না। প্রথমে কিছুদিন ভালোই চলল। তারপর একদিন হঠাৎ দেখি ৫-৬ মিনিট পর পর কলচার্জ উঠছে আর ১০-১২ টাকা করে ব্যালান্স কমে যাচ্ছে। মোবাইল বন্ধ করে রাখলাম। দু-ঘন্টা পর আবার চালু করতেই একই ঘটনা। কিছুতেই কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করতে পারছি না। বহু চেষ্টার পর যোগাযোগ করতে পারলাম। কিন্তু সমস্যা বলতে বলতেই লাইন কেটে গেল। সেদিনই পুরো ব্যালান্স শেষ হয়ে গেল। সেই সময়ে টপ আপ চালু হয়নি। মাসে ৩৫০ টাকা মতো ভরতে হত। তাতে যা টকটাইম পাওয়া যেত তাতেই মাস চালাতে হত। আর কিছু করার ছিল না, বিএসএনএল ত্যাগ করলাম, পরে রিলায়েন্স নিলাম। সেখানে নিজের নেটওয়ার্কে অনেক কম পয়সায় কথা বলা যেত। বন্ধুদের সবারই রিলায়েন্স ছিল তাই সমস্যা হত না। তারপর কোনো একদিন তোর্ষা নদীর রেলব্রিজের ওপর থেকে নিচে জল দেখতে গিয়ে নিচু হওয়া মাত্র বুকপকেট থেকে মোবাইল ফোনটা জলে পরে গেল। আপদ গেল। এরপর অনেকদিন ফোন ছাড়াই ছিলাম।
তারপর ২০০৭-এ চাকরি পাওয়ার পর আবার একটা ফোন নিলাম, সেই সময়ে বিএসএনএল থেকে বিনামূল্যে সিমকার্ড দিত। সেটাই নিয়ে নিলাম। সেই সময়ে কিন্তু ভালো পরিষেবা পেয়েছিলাম। কিছু জায়গাতে টাওয়ারের সমস্যা থাকলেও নিজের নেটওয়ার্কে অনেক কম পয়সাতে কথা বলা যেত। বেশ কিছুদিন ব্যবহার করার পর আস্তে আস্তে সব সুবিধা বন্ধ হতে থাকল। তারপর শুরু হল টাওয়ারের সমস্যা। বাধ্য হয়ে আর একটা রিলায়েন্সের সিম নিলাম। তখন পোর্ট চালু হয়নি আর সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ওই নম্বরটা দেওয়া হয়ে গিয়েছে। যাই হোক, আছে যখন ব্যবহার তো করতে হবে। একদিন ফোন করতে গিয়ে দেখলাম, কিছুতেই কল হচ্ছে না। কি মনে হতে ব্যালান্স চেক করে দেখি ১ পয়সা পড়ে আছে। ইনবক্সে একটা বার্তাও আছে — আমি নাকি বিউটি টিপস অ্যালার্ট সার্ভিস চালু করেছি। ভয়ানক ব্যাপার। আবার ফোন করলাম গ্রাহক পরিষেবা দপ্তরে — যান্ত্রিক গলার জাল পেরিয়ে এবারে মানুষের সাথে কথা হবে। কানে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছি — আপনার কল আমাদের কাছে মূল্যবান, দয়া করে লাইনে থাকুন। এভাবে কানে ফোন ধরে থাকতে থাকতে হাত ব্যথা হয়ে গেল। হেডফোন নিয়ে আসলাম। কানে ওটা লাগিয়ে আরও ৪৫ মিনিট কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে বাজারও করে ফেলেছি, চা বানিয়ে খেয়েও ফেলেছি। কানে ওই হেডফোন দিয়েই। এরপর একটা সময়ে লাইন কেটে গেল। মূল্যবান কলের মূল্য চোকানোর ভয়ে সম্ভবত। তখন রোখ চেপে গিয়েছে, আবার ফোন করলাম। ওই একই ঘটনা। শেষকালে হাল ছেড়ে দিলাম। এভাবেই চলছিল। মাঝে একটা সময়ে সব মোবাইল কোম্পানির কলচার্জ বেশ কমই ছিল। নিজের নেটওয়ার্কে অনেক সুবিধাও পাওয়া যেত। কিন্তু গ্রাহকসংখ্যা যে গতিতে বেড়েছে কলচার্জও সেই একই গতিতে বাড়ছে — দেশ উন্নতি করছে — তাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মহার্ঘ্য হবেই। সোনার দাম কমবে, কিন্তু আলু পেঁয়াজের দাম বাড়বে।
এরপর আরও কয়েকবার বিভিন্ন কারণে গ্রাহক পরিষেবায় ফোন করার দরকার হয়েছিল, কিন্তু প্রত্যেকবারই ন্যুনতম পরিষেবাও কপালে জোটেনি। আমি জিপিআরএস ব্যবহার করতে গিয়ে বারে বারে ঠকেছি। পুরো মাসে মোবাইল-নেটের টাকা ভরে ২-৪ দিন করা গিয়েছে, বেশিরভাগ সময়েই কানেকশন ফেইলড বা এরর ইন নেটওয়ার্ক কানেকশন। পাশাপাশি একটা এয়ারটেলের সিম আছে। মাসুল বেশির দিকে হলেও দুর্দান্ত পরিষেবা। সরকারি পরিকাঠামোয় আমাদের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় পুষ্ট বিএসএনএল-এর যে পরিষেবা দেওয়ার কথা ছিল, সেরকম পরিষেবা বেসরকারি কোম্পানিগুলো দিতে পারছে কী করে? আর ফোনের মাসুল যে তাদের বেশি এমনও না, কিছু ক্ষেত্রে কমই। উপরন্তু তাদের পরিষেবার গুণমান বাড়ছে। তার মানে তারা লাভও করছে। অথচ এরা অনেক পরে এসেছে বাজারে। যে বাজারের পুরোটাই একসময়ে বিএসএনএল-এর ছিল। আর তাদের কলচার্জও কম ছিল না। তাহলে এই অবস্থা কেন হল? কিছুকাল আগে কাগজে পড়েছিলাম — টুজি কেলেঙ্কারির পর নতুন করে দরপত্র দিতে গিয়ে কোম্পানিগুলোর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে, আর সেটা পূরণ করতে গেলে ফোনের মাসুল বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। আর সেটাই ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি কী অনায়াস দক্ষতায় প্রতিবাদহীন ভাবে নীরবে মিটিয়ে দেওয়া গেল — আর তার ভার বহন করার জন্যে ১২০ কোটি মানুষ তো আছেই।
আমার একটা কম্প্যুটারও আছে। ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে হবে। তখন ২০০৮ সাল, ব্রডব্যান্ড নেওয়া যেত, কিন্তু আমাকে মাঝে মাঝেই ঘর পাল্টাতে হত বলে একটু অসুবিধে ছিল। তখন ইউএসবি মোডেম আসেনি বাজারে। বিএসএনএল অফিস থেকেই নতুন একটা জিনিস পাওয়া গেল, সিডিএমএ ডেটা কার্ড ইভিডিও। মাসে ২৫০ টাকায় সীমাহীন ব্যবহার, গতি ছিল ২০-২২ কেবিপিএস। সেটাই তখন অনেক। কিছুদিন চলল। তারপর একদিন দেখি লাইন নেই। কী ব্যাপার? অফিসে গিয়ে শুনলাম, আমার অনেক টাকা বাকি আছে। আমি তো প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে বিল দিয়ে এসেছি। বাকি আসল কোথা থেকে? অফিসার জানালেন, তিন মাস আগেই প্ল্যান পরিবর্তন হয়ে মাসে ৫৫০ টাকা হয়ে গিয়েছে। আমার ১৬০০ টাকা বিল বাকি। বাকি টাকা মিটিয়ে আবার লাইন চালু করলাম। মাস কয়েক পর আবার সেটাই হয়ে গেল ৭৫০ টাকা মাস। কিন্তু গতি সেই ২০-২২ কেবিপিএস-এই আটকে। অতএব ইভিডিও ত্যাগ করলাম।
এবারে নিলাম ব্রডব্যান্ড, মাসে ১০০০ টাকায় সীমাহীন ব্যবহার। সাথে মাসে ৪৫০টা কল ফ্রি। এই প্রথমবার বিএসএনএল-এর কোনো পরিষেবায় বেশ ভালো লাগল। কিন্তু আমার কপালে সুখ বেশিদিন টেঁকে না। একমাসে বিল আসল ১২০০ টাকা মতো, কী ব্যাপার? এত ফোন তো হয়নি! পোর্টাল থেকে বিলের হিসেব বার করে দেখলাম, বিএসএনএল ছাড়া বাকি সব ফোনে কথা বলার জন্যে টাকা নেওয়া হয়েছে। গেলাম অফিসে। গিয়ে জানলাম, এরপর থেকে ফ্রি কল ২৫০ আর তা শুধুমাত্র বিএসএনএলেই করা যাবে। মেনে নিলাম। আবার কয়েকমাস পর বিল আসল ১৫০০ টাকা। এবারে গিয়ে শুনলাম প্ল্যান চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে, আর ফ্রি কল নেই। গ্রাহককে জানানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করেনি কর্তৃপক্ষ, আর এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে গেলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।
কেন যায় না সেটাও জানি না। তারপরও নেট ব্যবহার করতে হবে। গত ২ মাস ধরে অবস্থা খুব খারাপ। একটানা ১০ মিনিটও লাইন থাকত না। দরকারি কাজ করতে বসে বার বার বিপদে পড়তে হয়। ট্রেনের টিকেট কাটাই হোক বা এলআইসির প্রিমিয়াম দেওয়াই হোক। সম্প্রতি আমার বন্ধু এসে জানালো, তার অস্বাভাবিক বিল এসেছে। অফিসে গিয়ে শুনেছে, প্ল্যান বদল হয়ে গিয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছিল। আমার বাড়িতে তিনটে খবরের কাগজ আসে — আনন্দবাজার পত্রিকা, উত্তরবঙ্গ সংবাদ আর দি স্টেটসম্যান। কয়েকদিনের কাগজ নিয়ে খুঁজতে বসে এই ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল না। কিন্তু যেটা দেখলাম সেটাও খুব ভালো কিছু নয়। উত্তরবঙ্গ সংবাদের ৩০ জুন ২০১৪ সংস্করণের তৃতীয় পাতার প্রথম কলামে হেডলাইন পেলাম, উত্তরবঙ্গ জুড়ে বিএসএনএল পরিষেবা ভেঙে পড়েছে, উদাসীন কর্ত্তৃপক্ষ।
সংবাদটির তিনটি মূল বিষয়ের মধ্যে দুটি কিন্তু খুবই চিন্তার — প্রথমত বিএসএনএলের এক শ্রেণীর কর্তা বেসরকারি কোম্পানির সাথে মিলে সরকারি সংস্থার মান খারাপের চক্রান্তে লিপ্ত। আর দ্বিতীয়ত, নিগমের ছোটো বড়ো কর্তারা গ্রাহকদের টেলিফোন পেলে কথা বলতে চান না। খবরটা পড়ে কী করা উচিত আমি বুঝে উঠতে পারিনি। আরও কিছু কাগজ নিয়েও দেখলাম, বিএসএনএলের পরিষেবার বেহাল অবস্থা নিয়ে বারে বারে লেখা হয়েছে, কিন্তু অবস্থার উন্নতি কিছু হয়নি। এটা হয়তো বলবেন যে ভালো কাজ করলে সেটা সেরকম ভাবে দেখানো হয় না, কিন্তু খারাপ ব্যাপারটা বেশি করে তুলে ধরা হয়। কিন্তু দিনের পর দিন যদি সেটা চলতে থাকে তাহলে ওটা আর গ্রহণযোগ্য যুক্তি হয় না। যেখানে পরিষেবা কিনতে বেশ ভালোই দাম দিতে হচ্ছে।
Leave a Reply