চূর্ণী ভৌমিক, কলকাতা, ১৫ জানুয়ারি#
স্মিতা যখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন ওর বাবা মারা যান আর ওর মা মারা যান ঠিক তার পরের বছরেই। ও আর ওর বোন সংযুক্তা মিলে একসঙ্গে থাকে একটা বাড়িতে। বাড়ির উপরে থাকে ওর সৎ দাদা সমজিৎ রায় এবং তার স্ত্রী মৌসুমি। ঠাকুমার নামে লেখা এই বাড়িটাতে ওদের সকলেরই ভাগ রয়েছে। সদ্য আলাপ হওয়া মেয়েটির সম্বন্ধে এর চেয়ে বেশি আর কিছুই জানতাম না। বাবা মায়ের কাছে আদরে বড়ো হওয়ার ফলে এরকম একটা পরিস্থিতির কথা আমি প্রায় কল্পনাই করতে পারি না, ভয় লাগে, কষ্টও হয়। মনে মনে স্মিতাকে তাই বেশ সাহসী বলেই মনে হয় আমার। আর খুব খাটুয়ে। একটা বাড়ি চালাতে গেলে রান্নাবান্না করার পাশাপাশি গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটির অফিসে, ব্যাঙ্কে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় অনেক। মাঝেমাঝেই শুনি ও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিওলজি বিভাগের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী স্মিতা রায়। ঋষিদার সঙ্গেও আলাপ হয় আমার। ও আর স্মিতা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বন্ধুবান্ধবদের মতোই বিয়ে করতে চায় না, একসঙ্গে থাকে স্মিতার বাড়িতেই। ঋষিদা আর স্মিতার পক্স হল কয়েকদিন আগে, দুজনে দুজনকে সেবা করে সারিয়ে তুলল সেই নিয়ে কত হাসাহাসি।
হঠাৎ পরশুদিন দেখি স্মিতার মুখে হাসি নেই। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অগোছালো কিছু কথা বলল যা গুছিয়ে নিলাম আমি মনে মনে। ওর স্বাধীন চলাফেরা নিয়ে ওদের পাড়ার লোকেদের একটা চাপা অস্বস্তি ও অপছন্দ ছিল সে কথা জানতাম। ১২ তারিখ সন্ধ্যেবেলা পাড়ার লোকেরা প্রায় ওদের ওপর চড়াও হয়। সঙ্গে ছিল ওর সৎ দাদাও। তারা পুলিশ ডেকে এনে অভিযোগ করে যে স্মিতা এবং ঋষিদা অবিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও কেন একসঙ্গে থাকবে। শুধু তাই নয়, ওর বাড়িতে পুরুষবন্ধুরা আসে এবং মদ সিগারেট খাওয়া হয় যা তাদের পছন্দ নয়, যদিও স্মিতার কথা অনুযায়ী কাউকেই কখনো বিরক্ত করেনি ওরা। এছাড়া এলজিবিটি কমিউনিটির লোকজনদের যাতায়াত থাকাটাকেও কেউ সুনজরে দেখছে না। বরানগর থানায় ওর নামে অভিযোগ দায়ের করে পাড়ার লোকজন। ঋষিদার বাবা সেদিন সন্ধ্যেবেলা সৌভাগ্যবশত স্মিতার বাড়িতে ছিলেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন এই ছেলেমেয়েদুটির কথা। বলেন যে ভবিষ্যতে ওরা বিয়ে করবে। তাতেও লাভ হয় না।
পুলিশ ওকে বলে, মদ সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দিতে এবং যাদের দেখে ‘ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না’ তাদের যাতায়াত বন্ধ করে দিতে। স্মিতার পক্ষে এই বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে উঠে যাওয়া সম্ভব নয়। এখন ও কী করবে? ওর সবসময়ের ভরসা, ওর পরিবারহীন জীবনের অবলম্বন যে বন্ধুরা সেই বন্ধুদের বলবে ওর বাড়িতে না আসতে? নিজের বাড়ির ভেতরও স্বেচ্ছায় সিগারেট খেতে চাইলেও খেতে পারবে না? ও যদি হত একজন মাঝবয়সী পুরুষ কিংবা যদি ওর মা-বাবা বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হত কি ওকে? যদি থাকত বড়োলোকেদের পাড়ায়? অনেক পয়সা থাকত হাতে? মনে হয় না। ৯নং অরবিন্দ সরণীর বাসিন্দা এই মেয়েটি আজ বেশ বিপন্ন। ও সত্যিই কারুর ক্ষতি করেনি, শুধু নিজের মতো করে চলতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে কৌতূহলী চোখ ও শাসন। একজন নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছায় একসঙ্গে থাকলে কাউকে না জ্বালালে আপত্তির কী আছে? কী আছে যদি কারুর বন্ধু হয় একজন মানুষ যে না-নারী, না-পুরুষ? বিপদগ্রস্ত বোধ করছে কি ওর পড়শিরা সত্যিসত্যিই? কীরকম বিপদ? জানতে ইচ্ছে করে।
Leave a Reply