৬ নভেম্বর, ফারহা খান, আকড়া, মহেশতলা#
আমি তখন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি। আমাদের সাত-আটটা করে পিরিয়ড থাকত। মনে আছে, প্রথম পিরিয়ডে জিয়োগ্রাফির ক্লাস ছিল। ম্যাডাম এসে যখন ক্লাস নিচ্ছিলেন, পপুলেশন বলে একটা চ্যাপ্টার ছিল। ক্লাসের মধ্যে পড়াতে পড়াতে উনি বলেন, বেশিরভাগ জনসংখ্যা হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের। একটা লোকের তিনটে করে বিয়ে আর দুটো করে বাচ্চা হয়, মোট ছ-টা বাচ্চা হয় মুসলমানদের। শুনে আমার খুবই খারাপ লাগল। ক্লাস ওভার হয়ে যাওয়ার পর মুডটা খারাপ হয়ে গেল। পিছনের বেঞ্চে বসেছিল আমার খুব ভালো বন্ধু সঞ্চারী, ও হয়তো ম্যাডামের কথার মানেটা বোঝেওনি, হুট করে জিজ্ঞেস করে আমায়, ‘তুই তোর বাবার কত নম্বর সন্তান?’ আমি শুনে কী বলব? দ্বিতীয় ক্লাস তখনও শুরু হয়নি। আমি বাথরুমে ছুটে গিয়ে খুব কেঁদে নিলাম। কেন জানি না আমার মনে হয়েছিল, আমার বাবাকে অপমান করা হয়েছে, ধর্মের ব্যাপারটা অত বুঝিনি। তাই আমি কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। টিফিন অবধি এর জের চলল। আমি ক্লাসের পড়াতেও মন বসাতে পারছিলাম না। হঠাৎ কী যে হল, ক্লাসে এসে সবার সামনে আমি সঞ্চারীকে ঘুরিয়ে একটা চড় মারলাম। মেরে চিৎকার করে বললাম, ‘আমি আমার বাবার একমাত্র স্ত্রীয়ের একটাই মেয়ে।’ জিওগ্রাফি ম্যাডাম জানতেন না এসব হয়েছে। সঞ্চারী গিয়ে আমার নামে প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করল। আমার তখন জেদ চেপে গেছে। আমি ভাবলাম, আমি কোনো ভুল করিনি, আমার কোনো ক্ষতি হতে পারে না। প্রিন্সিপাল এসে আমাকে ডাকলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কেন আমি ওকে চড় মেরেছি? আমি জিওগ্রাফি ক্লাসের ঘটনাটা প্রিন্সিপালকে খুলে বললাম। জিওগ্রাফি ম্যাডামকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ক্লাসে ম্যাডাম মুসলমান জনসংখ্যা নিয়ে ওরকম মন্তব্য করেছেন কিনা। ম্যাডাম তা অস্বীকার করলেন। আমাকে বলা হল, তুমি সঞ্চারীর কাছে ক্ষমা চাও। আমি কিন্তু সেইসময় ক্ষমা চাইনি। আমাকে জানানো হল, গার্জেন কল করা হবে। কিন্তু সেসব করা হয়নি। মনে হয়, ওঁদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছিল। তারপরে ওই ম্যাডাম আমার কাছে এসে বলেছিলেন, তাঁর ভুল হয়েছিল।
বিদ্যাভারতীতে পড়াকালীন আমি প্রচুর ঝামেলা ফেস করেছি। যেমন, সাজগোজ নিয়ে। একবছর তিনখানা ঈদ ছিল। সাধারণত ঈদ হয় দুবার, ঈদলফেতর আর ঈদজ্জোহা। সেবার দুটো ঈদলফেতর আর একটা ঈদুজ্জোহার তিনদিন ছুটি হওয়ার ফলে আমাকে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তোদের এত পরব কেন?’ যেহেতু তখন আমি ক্লাসে একাই ছিলাম, আমি অসহায় বোধ করলাম। এখন অনেক মুসলিম মেয়ে ভরতি হয়েছে। আমি ইংলিশের ম্যাডামকে গিয়ে নালিশ করলাম। তিনি বললেন, ‘তোদের না হয় তিনদিন, আমাদের তো বারোমাসে তেরো পার্বণ।’ এখনও কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক কিছু ফেস করি। কিন্তু তার প্রত্যুত্তর আমি দিতে পারি। তখন ছোটো ছিলাম, তাই সঞ্চারীকে মেরেছিলাম। আমার এখন সেটা ভাবলে খারাপ লাগে। সত্যিই আমার কথার মাধ্যমেই ওকে বোঝানো উচিত ছিল। পরে ও অবশ্য আমার কাছে এসে দুঃখপ্রকাশ করেছিল। ঘটনাচক্রে কলেজে আমরা দুজনে একসঙ্গে পড়তে গিয়েছিলাম। সঞ্চারী হয়তো পরে আরও ব্রডলি বিষয়গুলোকে দেখতে শিখেছে। কিন্তু এখনও এসব ভাবনা মানুষের মধ্যে রয়েছে। ট্রেনে যাতায়াত করতে গিয়েও নানা আলোচনা শুনতে পাই। আমার মনে হয় সেরকম অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করা উচিত। আমার একটা ছোটো বোন রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ছে। ওখানকার টিচার পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, শাহরুখ খান থেকে শুরু করে সব মুসলমানরা টেররিস্টদের সঙ্গে যুক্ত। এসব মন্তব্য শিক্ষক হয়ে করেন কী করে?
Leave a Reply