বৈশাখী বিশ্বাস। শান্তিপুর। জুলাই ১৩, ২০২০।#
সারা বিশ্বকে থমকে দিয়েছে এক মহামারি। বিশ্বসংসার তার পরিচিত ছন্দ হারিয়েছে। মানুষের মনে শুধুই ভয়, অবিশ্বাস। টিভি, খবরের কাগজ, মুঠোফোন – সব জায়গায় শুধুই মৃত্যু আর মৃত্যু। বাঁচার গল্প যেন কতদিন শুনিনি। নিজের পরিচিত মানুষগুলোকেও যেন আড়চোখে দেখছি। সম্পর্কগুলো যেন ছিন্ন হবার পথে। কিন্তু এটা তো জীবন নয়! এ কোন সময়ে এসে দাঁড়ালাম? কোন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমরা যাচ্ছি? স্কুল- কলেজ বন্ধ। আমি শিক্ষিকা হওয়ায় স্বভাবতই আমার পরিচিত কর্মজগৎ থেকে দূরে। সব জায়গায় একটাই কথা- ‘সোশ্যাল ডিস্টান্সিং’। রাষ্ট্র বলছে, সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজে বাঁচো।
এইভাবে মনখারাপের পৃথিবীতে বাস করতে করতে একদিন পেলাম আলোর দিশারীকে। যে সন্ধান দিল এই অচলায়তনের বাইরের পৃথিবীর। শান্তিপুর সাজঘর আয়োজিত নাট্য কর্মশালা শুরু হল গত ২২ জুন। আমি নাট্যকর্মী নই কিন্তু কয়েকজনের উৎসাহে এবং এই বন্দীদশা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে যোগ দিলাম এই কর্মশালায়। আমার জীবনের প্রথম নাটকের ওয়ার্কশপ। বিষয় ‘অভিনেতার প্রস্তুতি ও অভিনয়’। আর সেখানেই দেখা পেলাম- নাট্যকর্মশালার প্রশিক্ষক- আমার প্রিয় একজন অভিনেতা কৌশিক চ্যাটার্জি’র।
নাট্যকর্মশালায় যোগ দিতে যাবার আগের মুহূর্তে কী টেনশন! কোনোদিন অভিনয় করিনি। যাচ্ছি কোথায়?- নাট্যকর্মশালায়। কিন্তু যাওয়ার পরে ওই কর্মশালায় শেখা কয়েকটি শব্দ – ‘স্পর্শ’, ‘বিশ্বাস’, ‘বোঝাপড়া’, ‘নিজেকে চেনা’ – যেন মুহূর্তেই এই ভয়ার্ত পরিবেশ থেকে মনকে মুক্তির স্বাদ দিল। নাট্য কর্মশালায় কৌশিক স্যার কতরকমের এনার্জি বাড়ানো ব্যায়াম করালেন। মুগ্ধ হলাম। কী অদ্ভুত ব্যাপার! – ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘আমি’, ‘তুমি’ –এই চারটি শব্দ দিয়ে কী সুন্দর কাহিনি বিন্যাস করে নাটক তৈরি হয়ে গেল!
নাট্যকর্মশালার দ্বিতীয় দিন। যে মুহূর্তটা ভাবলে এখনও কী অনন্য এক অনুভূতি হয়! যা মনের গভীরকে স্পর্শ করে। ‘নিজেকে চেনা’ – সত্যিই তো আমরা কি নিজেকে চিনি যথাযথভাবে? কোনটা আমার খারাপ দিক, কোনটা ভালো- না খুঁজে অন্যের দোষ দেখতেই ব্যস্ত। কী আমার আনন্দ কী বেদনা – সব বেরিয়ে এসে যেন ওই মুহূর্তে এক নতুন আমি’র জন্ম হল। সে আমি রাগতে জানেনা- সকলকে ক্ষমা করতে, ভালোবাসতে জানে। জীবনের প্রথম নাট্যকর্মশালা জীবনকে সুন্দর করার মন্ত্র দিল।
শেষদিন আমরা প্রশিক্ষণ নিলাম বাবলিদার কাছে মূলত মেক আপের উপর। সেদিনও আরেক বিস্ময়। আমরা প্রত্যেকে নিজেরা নিজেদের মত সাজলাম। তার থেকেই উঠে এল নানা চরিত্র। তৈরি হল কাহিনি। কিন্তু আশ্চর্য, এই কয়দিন কোথায় গেল মহামারির আতঙ্ক! কোথায় গেল সামাজিক দূরত্ব বজায়ের প্রাণান্ত চেষ্টা। থিয়েটার তো সামাজিক দূরত্বের পরিপন্থী।
জানি বিশ্বজুড়ে মহামারীর তান্ডবলীলা চলছে। এই মুহূর্তে এই শিল্পচর্চাকে অনেকেই আদিখ্যেতা মনে করবে। তবু বলি, শিল্পের মৃত্যু নেই। শিল্পীরা কোনো পরিস্থিতিতেই থেমে যায়না। এখন আমরা একটা মহামারির কবলে আছি ঠিকই। এই সময় নাট্যচর্চা নিয়ে হয়তো বিতর্ক উঠবে। তবু বলি, আবেগকে মেরে ফেলে কি আমরা সুস্থ সুন্দর নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখতে পারব? যাই হোক, আমার কাছে এই কর্মশালা অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো। জানি চারদিনে থিয়েটার শেখা যায়না কিন্তু অভিনয় জগতে আসার অনুপ্রেরণা তো পাওয়া যায়। সুন্দরভাবে সবাইকে নিয়ে বাঁচার খোঁজ তো মেলে। এই নাট্যকর্মশালা আমার মনে থেকে যাবে চিরকাল।
Leave a Reply