দীপংকর সরকার, হালতু, ১৭ সেপ্টেম্বর#
এটা খুবই অনুতাপের বিষয় যে, আমরা অনেকেই শান্তিনিকতন যাই মাঝে মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধের আশ্রম দেখতে, খোয়াইয়ের প্রাকৃতিক রহস্য উদ্ঘাটনে। কিন্তু বোলপুরের আশে পাশে হারিয়ে যাওয়া মন্দির স্থাপত্যগুলির খোঁজ আমরা ক’জনই বা রাখি। এমনই হারিয়ে যাওয়া গ্রামের নাম সুপুর ও লাভপুর। প্রত্নতাত্বিকদের কাছেস্থানদুটির নাম পরিচিত হলেও সাধারণের কাছে আজও এই গ্রামগুলি অচেনাই থেকে গেছে। কথিত আছে সুপুর ও লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরার মন্দির হল সতীর একান্ন পীঠের একপীঠ। প্রত্যেক বছর মাঘি পুর্ণিমায় এখানে বড় মেলা বসে।
ভোরের ৬-০৫-এর গণদেবতা ধরে বোলপুর স্টেশন, সেখান থেকে চুক্তিবধ রিক্সায় চেপে রওনা হলাম। বোলপুর স্টেশন থেকে কবি জয়দেব রোড ধরে প্রায় ১৪ কি.মি. ভেতরে অজয় নদীর তীরে সুপুর গ্রাম। রিক্সায় যেতে যেতেই উঁচু নীচুঁ লাল সুরকী বিছানো মাটির রাস্তার দুধারে গ্রামের দৃশ্য সকলেরই চোখ টানে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে রাস্তার পাশে দোতালা তিনতলা মাটির দেওয়ালের বাড়ী তার পাশে চড়ে বেড়াচ্ছে গরু, মোষ, ছাগল। শান্ত, সামাহিত নিস্তরঙ্গ এই গ্রামের মধ্যেই একদা গত আঠেরো শতকে ঘাঁটি গেড়েছিল ফরাসী বণিকরা।
সুপুরের প্রধান আকর্ষণ এখানকার জোড়া মন্দির। মন্দিরের চারপাশের দেওয়ালে টেরাকোটার নঁকশা বাংলার অতিপরিচিত শিল্পসত্তাকে মনে করায়। মন্দিরের সামনের দিকে দেবী দুর্গা তার পরিবার সহ বিরাজমান। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানেই মন্দিরটি সংরক্ষিত। তবে মন্দিরের বহু অংশেই ভগ্ন দশা চোখে পড়ার মতো।
রিক্সা চালক আমাকে জোড় মন্দিরের সামনে এনে দাঁড় করালেন। আমি এক ঘন্টার মধ্যে ঘুরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন্দির চত্বরের ভিতরে ঢুকলাম। মন্দিরের চারপাশ দেখার পর আমি গ্রামের ভিতরে লাল সুরকীর পথ ধরলাম। ছবিও তোলা হল। এখানে একটু এগিয়ে বাদিকে চোখে পড়ল গ্রামের সবথেকে প্রাচীন সুরাটেশ্বর শিব মন্দির। মূল মন্দিরের অংশ নেই বললেই চলে। তবে কিছু ভাঙা স্তম্ভ ও বিগ্রহ আশে পাশে ছড়িয়ে রয়েছে। গ্রামের আরও ভিতরে যেতে যেতে কাঁচা রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি ভাঙা মন্দির। ছবি তুলে রাখলাম মন্দির গুলোর এই ভেবে যে আগামী দিনে হয়ত এগুলিও হারিয়ে যাবে। বাংলার স্থাপত্য শৈলীর এই নিদর্শনগুলি যে ক্রমশঃ ধ্বংষের মুখে এগিয়ে চলেছে তা ভাবতে ভাবতেই ফিরে এলাম রিক্সা চালকের গাড়ীর সামনে।
বাংলার আনাচে কানাচে এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন ও মধ্যযুগের স্থাপত্য-ভাস্কর্যের নিদর্শন। যেগুলির অধিকাংশই রয়েছে লোক চক্ষুর আড়ালে এবং উপেক্ষিত। আমার খোঁজ এই উপেক্ষিত পরিত্যক্ত বাংলার হারিয়ে যাওয়া গ্রাম, হারিয়ে যাওয়া শিল্প, আড়ালে থাকা প্রকৃতিকে ঘিরেই। বিষাদ মনে রিক্সায় বোলপুর স্টেশনে ফিরে বামদেব লোকালে বর্ধমান। সেখান থেকে হাওড়া ফিরলাম।
Leave a Reply