জিতেন নন্দী, ৩ মার্চ#
আজ আমরা সকাল দশটা পাঁচের বনগাঁ লোকালে শিয়ালদা থেকে যাত্রা শুরু করি। আমাদের মন্থন পত্রিকার বন্ধুরা ছাড়াও ছিলেন সোনারপুরের ‘লেখক শিল্পী ঐক্যমঞ্চ’-এর শম্ভুনাথ মণ্ডল ও মৃন্ময় চক্রবর্তী, একক মাত্রা পত্রিকার সৌমিত্র, তবু বাংলার মুখ পত্রিকার সুভাষ দাস। এছাড়া উল্টোডাঙা, দমদম এবং মাঝের বিভিন্ন স্টেশন থেকে অন্য বন্ধুরাও ট্রেনে ওঠেন। ছিলেন নৈহাটির ছোটো পত্রিকা পরিপ্রশ্ন-র বন্ধুরা। আমাদের সকলের গন্তব্য ছিল বনগাঁ।
দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছাই। স্টেশনের বাইরে এসে দেখি আরও অনেকে এসে জড়ো হয়েছে। ‘বনগাঁ নাট্যচর্চা কেন্দ্র’-র শিল্পীরা ইতিমধ্যেই গান শুরু করে দিয়েছিলেন। আমরা সকলে জড়ো হচ্ছি। দেখি সামনে একটা ছোট্ট মিছিল এল। সামনে ব্যানার ‘বনগাঁ জাতীয়তাবাদী যুব পরিষদ’, প্রত্যেকের হাতে একটা করে জাতীয় পতাকা। সে কী! এরা কি তবে রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের জন্য অভিনন্দন জানাতে সীমান্তে যাচ্ছে? না, জানা গেল, এরাও সীমান্তে যাবে শাহবাগের আন্দোলনকে সংহতি জ্ঞাপন করতে। যাই হোক ওরা একটা ম্যাটাডোরে মাইক নিয়ে বক্তৃতা দিতে দিতে এগিয়ে গেল। আমরাও কিছুক্ষণের মধ্যেই সীমান্ত অভিমুখে পা বাড়ালাম। অল্প দূরত্ব যাওয়ার পরই চাকদা মোড় থেকে শান্তিপুরের রঙ্গপীঠ নাট্য সংস্থার বন্ধুরা একটা মাথা ঢাকা ট্রাকে করে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হল।
বিশাল কোনো মিছিল নয়। কিন্তু আবেগ ও আন্তরিকতা নিয়ে একদল মানুষ চলেছে বেনাপোল সীমান্তে। সামনে বনগাঁর ওই শিল্পী বন্ধুরা গিটার আর ডুগডুগি বাজিয়ে নেচে নেচে গাইতে গাইতে চলেছে। ওদের সঙ্গেই যোগ দিয়েছে ‘আমরা’ গোষ্ঠীর বাবলা আর কয়েকজন যুবক, যারা এসেছে উত্তর ২৪ পরগনার বনগ্রাম থেকে। তারই পিছনে হেতুবাদী পত্রিকার ব্যানার নিয়ে কয়েকজন এবং ব্যানারহীন বেশ কিছু মানুষ। শেষে ট্রাকে শান্তিপুরের রঙ্গপীঠের শিল্পীরা কবিতা ও গান পরিবেশন করে চলেছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর অবশ্য সেই শিল্পীরাও রাস্তায় নেমেই গান গাইতে শুরু করলেন।
দীর্ঘ পথ, আন্দাজ প্রায় ৯-১০ কিলোমিটার। জনবহুল অঞ্চল পেরিয়ে যাওয়ার পরও মাঝে মাঝে পথের মোড়ে জটলা, দূরে গ্রামের ঘর থেকে বউ, বাচ্চারা বেরিয়ে এসেছে। সকলেই বুঝতে চাইছে, কারা এরা, কোন পার্টি, কোথা থেকে এসেছে? প্রচলিত মিছিলের সারিবদ্ধ ঢঙটা নেই, একটু এলোমেলো। নিজেদের গানের উত্তেজনায় নিজেরাই মত্ত। এ কেমন মিছিল! বেশ কিছু যুবক ক্যামেরা আর মোবাইলে ছবি তুলে চলেছে, কেউ ভিডিও করছে। বিলি হচ্ছে ফোল্ডার ‘জ্বেলে রাখো এই পবিত্র রাগ শাহবাগ শাহবাগ’, ‘আমাদের লোকালয়’ এবং ‘সংবাদমন্থন’ পত্রিকার বাংলাদেশ বিষয়ক পত্রিকার কপি। প্রথমদিকে যখন শ্লোগান উঠল, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি, বাঙালি’, সকলেই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিল, কিন্তু যখন চেঁচিয়ে বলা হল, ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’, একটু সকলের ইতস্তত ভাব, একটা অস্বস্তি। তখন মাইকে এই পদযাত্রা এবং বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের আন্দোলনের সমর্থনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হল। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরও রাজাকারদের প্রতি দারুণ ক্ষোভ! সেটা কিছু কিছু মন্তব্যে ভেসে আসছিল। আমাদের মেয়েরা একটা ভাতের হোটেলে খেতে ঢুকেছিল, সেখানেও সকলে সমস্বরে ফাঁসির আদেশকে সমর্থন জানালো। ফাঁসির মতো চরম শাস্তিদান নিয়ে পাল্টা যুক্তি অধিকাংশের মতদানে উড়ে গেল।
অবশেষে আমরা এসে পৌঁছালাম বেনাপোলে। সীমান্তরক্ষীদের তৃতীয় ব্যারিকেডের আগে আমাদের রুখে দেওয়া হল। এদিকে আমরা শুনলাম, সকাল এগারোটা থেকে ওপারের আন্দোলনকারী বন্ধুরা জিরো পয়েন্টের ওধারে এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কংগ্রেসিদের উদ্যোগে পাঁচজনের একটা দল সীমান্তরক্ষীদের এসির সঙ্গে কথা বলতে গেল। আমরা তো ওপারের ভাই-বোনেদের সঙ্গে মিলতে চাই, কথা বলতে চাই। কিন্তু সীমান্তের বাধা টপকাতে পারছি না। তবু ফারুক, শুভ, দীপঙ্কর এরকম কয়েকজন ঠিক পাশ কাটিয়ে জিরো পয়েন্টের গেট অবধি চলে গেল। আমিও ওদের পিছু পিছু গেলাম। আমার হাতে মন্থন পত্রিকার কিছু কপি দেখে ওপারের একজন ভাই ইশারায় চাইলেন। আমি দিতে যেতেই সাদা পোশাকের পুলিশ আমাকে আটকালো। তা সত্ত্বেও ম্যানেজ করে কাগজগুলো ওদের হাতে পাশ করে দেওয়া হল।
ইতিমধ্যে আমাদের মিছিলের জমায়েতটা অধীর হয়ে তৃতীয় ব্যারিকেড পার হয়ে অনেকটা সামনে চলে এল। আর ওই প্রতিনিধিরা ফিরে এসে জানালো আমাদের বক্তব্য এবং কাগজপত্র নিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে পাঁচজন। (জানি না ওরা কাদের প্রতিনিধি! এই প্রতিনধি ব্যাপারটা সবসময়ই বেশ গোলমেলে!) রঙ্গপীঠের এক মহিলা শিল্পী এসে সোজাসুজি বললেন, তিনিও বাংলাদেশের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চান। কিন্তু তাঁকে নিরস্ত করা হল। তাতে কী! আমরা আবার এদিক-সেদিক করে গেটে পৌঁছে গেলাম। আন্দোলনকারী দের সঙ্গে মত ও কাগজপত্র বিনিময় হল। সকলে হাত বাড়িয়ে দিল মেলানোর জন্য। একটা কাগজ পেলাম, দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে আল্টিমেটাম ১-৬, নিচে ‘গণজাগরণ মঞ্চ, প্রজন্ম চত্বর, যশোর’। বুঝলাম যশোরের আন্দোলনকারীরা এখানে এসেছে, তবে সঙ্গে শাহবাগের কয়েকজনও আছে। সেই কাগজটায় লেখা ছিল :
আল্টিমেটাম ১ : সাতদিনের মধ্যে জামায়েত-শিবিরের হাতে শহিদদের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে হবে।
আল্টিমেটাম ২ : ছাব্বিশে মার্চের পূর্বে জামায়েত-শিবিরকে নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
আল্টিমেটাম ৩ : জামায়েত-শিবিরের অর্থকরী প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা আইনের আওতায় আনার জন্য অবিলম্বে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
আল্টিমেটাম ৪ : ট্রাইবুনালকে স্থায়ী রূপ দিতে হবে অবিলম্বে।
আল্টিমেটাম ৫ : অবিলম্বে জামায়েত-শিবিরকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
আল্টিমেটাম ৬ : যুদ্ধাপরাধী পক্ষের গণমাধ্যমগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
আরও কিছু ছবি, প্রতিবেদকের তোলা ঃ
Leave a Reply