সোহিনী রায়, কলকাতা, ১০ সেপ্টেম্বর#
যখন প্রিয়া সিনেমা হলে পৌঁছোলাম, তখন বাজে চারটে তিপ্পান্ন। ঢুকে দেখলাম, সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজপুত্র আর সওদাগর পুত্র জলে চান করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পত্রলেখার আগমন হল। শুরু হল, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’। বুঝলাম, সিনেমাটার বিশেষ কিছু আমরা বাদ দিইনি। সিনেমা শেষ হল ছ-টা পঁচিশ নাগাদ। গোটা সময়টা একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল।
পাশাপাশি দুটো গল্প চলতে থাকে সিনেমা জুড়ে। গল্প দুটো খানিকটা সমান্তরাল হয়েও পুরোটা নয়। শেষে গিয়ে দুটো গল্প একটি নির্দিষ্ট বক্তব্যে মিশে যায়। একটি গল্প তাসের দেশ সিনেমায় যে ‘তাসের দেশ’ সিনেমাটির নির্দেশক (জয়রাজ), তাকে ঘিরে। অন্যটি রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ নৃত্যনাট্য নিয়ে, যেটি জয়রাজ কল্পনা করেছেন। একটি আমাদের ওপর চেপে বসা পুরোনো, পচনশীল সাংস্কৃতিক অনুশাসনের গল্প, অন্যটি রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের গল্প। একটিতে জয়রাজ যে যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, সেটি দেখানো হচ্ছে। অন্যটিতে তাসের দেশ হিসেবে দেখানো হচ্ছে রাষ্ট্রের মিলিটারি, যুদ্ধাস্ত্র, কড়া নিয়মের বন্ধন ইত্যাদিকে।
‘তাসের দেশ’-এর অংশটিতে রবীন্দ্রনাথের মূল সংলাপ হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। তাসের দেশের চিত্রায়ণ আমার অত্যন্ত ভালো লেগেছে। রবীন্দ্রনাথের সংলাপ খুবই মানানসই, বিশেষ করে তাসেদের মুখে। একেকটি তাসের উচ্চারণ ভঙ্গী একেকরকম। সবাই বাংলা বললেও, পুরোপুরি বাংলা টানে কথা বলে না। তবে কিছু সংলাপ, মূলত রাজপুত্র আর সওদাগর পুত্রের মুখে, গোটা দৃশ্যের মধ্যে দেখতে খানিক বেমানান। দুজনেই খালি গায়ে সবুজ আর কমলা রঙের বারমুডা পরে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথা বলছে, এটা দেখতে বেশ অসুবিধা হয়। যে দর্শক এই ধরনের দৃশ্যে ‘দিল চাহতা হ্যায়’ জাতীয় গান ও সংলাপ শুনে অভ্যস্ত, তাদেরকে চিত্রপরিচালক সম্ভবত এই অসুবিধাতেই ফেলতে চেয়েছেন।
তাসেদের পোশাক, পরিচ্ছদ, ব্যবহার, চলাফেরা, থাকার জায়গা (তাঁবু) অত্যন্ত উপভোগ্য। বিশেষ করে যখন রাজপুত্র-সওদাগর পুত্রকে ঘিরে ধরে, রাইফেল বাগিয়ে একের পর এক প্রশ্নবাণে চেপে ধরছে, তখন মনে হয় সত্যি দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। তাসের দেশ-এ একটি গে ও একটি লেসবিয়ান সম্পর্কের উত্থাপন পরিচালকের নিজস্ব অবদান। মনে হয়, কোনো একটা বক্তব্যে উপনীত হতে চাইছেন বলে এই সমকামী সম্পর্কের আমদানি জরুরি ছিল। পত্রলেখার চরিত্রটিকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে অন্যরকম ভাবে দেখানো হয়েছে — সেটা ভালোই লাগে। কিন্তু পত্রলেখার চরিত্রটিকে এত বিচিত্রভাবে, মানে তার মুখশ্রী, পোশাক-আশাক, কানে সেফটিপিন ইত্যাদি নিয়ে, এক কথায় যত উদ্ভটভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, এতটা না করলেও চলত। সিনেমাটির কিছু কিছু দৃশ্য প্রায় বিজ্ঞাপনের মতো, মোটেই ভালো লাগে না।
ছবিটার একটি জোরালো দিক হল গান। গোটা ছবি জুড়ে গানের ব্যবহার অসাধারণ। তাসের দেশের বহুশ্রুত সবকটি গানকে দৃশ্যপটের সাথে মিশিয়ে প্রায় একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে ছবিটি। এক্ষেত্রে ‘এলেম নতুন দেশে’, তাসের দেশের জাতীয় সঙ্গীত — বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। শেষ গান, মানে, ‘বাঁধ ভেঙে দাও’-ও ভারি ভালো লাগে। বিশেষ করে যখন ‘ইচ্ছে ইচ্ছে ইচ্ছে’ গানটির সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়। বাঁধ ভেঙে দাও শেষ হওয়ার সাথে সাথে বড়োই দুম করে শেষ হয়ে যায় সিনেমাটি। একটি পরিপূর্ণ সিনেমার চেহারা নেয় না যেন, মনে হয় কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রচারমূলক ছবি।
অন্য যে গল্পটি চলতে থাকে জয়রাজকে ঘিরে, সেটি একটি আদ্যন্ত তথাকথিত আর্ট ফিল্ম বলে পরিচিত সিনেমার মতো। ট্রেন, রেল লাইন, স্টেশন, আবছায়া, ভাঙা পুরনো জমিদার বাড়ি, আলো-আঁধারি, বিধবা মেয়ে, ঝোলা ব্যাগ, ছেঁড়া বই, রেল লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া, বিষণ্ণ সন্ধ্যা ইত্যাদি সম্বলিত ঋত্বিক ঘটক মার্কা চিত্রায়ণ। জড়দ্গব, প্রাচীন সংস্কৃতি বলতে ভাঙা বাড়ি, বহুরূপী, আর সেই সংস্কৃতির অনুশাসনে শোষিত বলতে বাঙ্ময়, ব্যথাতুর চোখওয়ালা সাদা শাড়ি শোভিত দুঃখী বিধবা, আর তাকে উদ্ধার করতে আসা ঝোলা ব্যাগ কাঁধে আঁতেল চিত্র পরিচালক ইত্যাদির চিত্রায়ণ ভারী ক্লিশে।
সিনেমাটিতে সাবটাইটেলের ব্যবহার অভিনব এবং চমৎকার। দুটো গল্পই শেষ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন, সাংস্কৃতিক অনুশাসন থেকে উত্তীর্ণ, যৌনভাবে স্বাধীন একটি জগতের দিশায়।
সাম্প্রতিক মন্তব্য