১৩ ফেব্রুয়ারি, অসিত রায়, কলকাতা#
‘একটু সুখের মুখ দেখবে বলে চুল সাদা করে বসে আছে সালেমানের মা আহমদের মা’, ১৯৫২ সালে যেখানে বসে এই লাইনগুলি লিখেছিলেন তিনি, সেই ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় ১২ ফেব্রুয়ারি পালিত হল পদাতিক কবি সুভাষের চুরানব্বইতম জন্মদিন। গত সাত-আট বছর ধরে এমনই ঘরোয়া আন্তরিক পরিবেশে বজবজের এই গ্রামে ত্রিশ-চল্লিশজন মানুষ তাঁর জন্মদিনে একত্রিত হচ্ছেন। ষাট বছর আগে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল এখানে কাটিয়ে গেছেন কবি। এখানে চটকলের শ্রমিকদের কাছ থেকে জীবনের পাঠ নিতে এসেছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি হয়ে গিয়েছিল, কারাবাসের পর সুভাষকে সোমনাথ লাহিড়ী নিয়ে আসেন এখানে। সবে গীতাদির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে। একটা ট্রাকে করে চৌকি-তোরঙ্গ নিয়ে চড়িয়ালের মোড়ে এসে নেমে পড়েন সুভাষ। ব্যঞ্জনহেড়িয়াতে হঠাৎ ঢুকে পড়ে তাঁর জায়গাটা ভালো লেগে গেল, তাই থেকে গেলেন।
২০১১ সালের ৮ জুলাই এখানে অমিয় দেব, শঙ্খ ঘোষের উপস্থিতিতে কবির স্মৃতিফলক প্রতিষ্ঠিত হয়। মহম্মদ মহসীনের বাবা ইয়াসিন হোসেন (জীবিত আছেন) এবং আহমদদার বাবা (প্রয়াত) ছিলেন কবি সুভাষের কাছের মানুষ। এদিনের সভায় সালেমানের মাও এসে হাজির হয়েছিলেন। বয়স তাঁর আশির কাছাকাছি।
ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় এসে সুভাষ প্রথমে থাকতেন মাটির বাড়িতে। কিছুদিন পর গ্রামের একটি বাচ্চাকে তাঁরা দত্তক নেন। তার নাম রেখেছিলেন মিমু, মানে মিছিলের মুখ। এখানে এসে নবদম্পতি অনেক মানুষকে জড়ো করার চেষ্টা করলেন, কিশোর বাহিনী গড়লেন, শহিদ প্রতিভা পাঠশালা করলেন। সকালবেলা সুভাষ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যেতেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন তিনি। বাচ্চারা তখন ধানের নাড়া কেটে জ্বালানি নিয়ে আসত বাড়িতে বাড়িতে, গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে বানাত, পড়াশোনার সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ ছিল না। এদের নিয়েই শুরু হয়েছিল গীতাদি আর সুভাষের প্রতিভা পাঠশালা। বই-খাতা-পেনসিল বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে কিনে নিয়ে আসতেন।
আহমদদার মা এসব কথা বলছিলেন। তাঁর বয়স এখন পঁচানব্বই। তাঁর স্বামী শেখ সাজ্জাদ আলী মারা গেছেন। সুভাষের থাকাকালীন আহমদদার বয়স ছিল বারো-তেরো। এখন তিনি অনেক পরিণত মানুষ, ট্রেড ইউনিয়ন করেন। বাবর আলী, যাঁকে নিয়ে সুভাষ কবিতা লিখেছিলেন, তিনিও থাকতেন এই পাড়ায়। আজ তিনি বেঁচে নেই।
এই সভায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন দেবাশিস, সনৎ, নজরুল, ইয়াকুবেরা। বজবজ থেকে এসেছিলেন ‘চিন্তাভাবনা’ পত্রিকার মানসী ও সুভাষ ঘোষ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এখানে ছিলেন, এই আবেগে জড়িয়ে আছেন পাড়ার মানুষ। বাড়ি বাড়ি থেকে কেউ চাদর, কেউ মাইক আর মুড়ি-চানাচুর-চা জুগিয়ে প্রত্যেক বছর অ-প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই অনুষ্ঠান চালিয়ে আসছে ব্যঞ্জনহেড়িয়ার মানুষ। এদিনের সভায় সভাপতি ছিলেন বাসুদেব মণ্ডল। গান করেন সুরজিত মণ্ডল ও সৈকত আলি মোল্লা। কবিতা পড়েন মানস ঘোষ, শাবানা পারভিন, সৃজন হাসান। শেষে দেখানো হল একটি তথ্যচিত্র।
আমি সভা থেকে ফিরছি আর মনে পড়ছে সুভাষের জীবনের শেষদিকের সেই কথা, আমার যে বন্ধুরা পৃথিবীকে বদলাবে বলেছিল, তর সইতে না পেরে এখন তারা নিজেরাই নিজেদের বদলে ফেলেছে, আমি একপায়ে এখনও পাদানিতে ঝুলছি।
Leave a Reply