৩১ মার্চ, তর্পণ সরকার, শান্তিপুর#
অন্য গানের ভোর কত দূর?
মিশকালো এই রাত।
দেখা হবার স্বপ্নে তবু
বন্ধু বাড়াও হাত।
এমন হাট বাড়ানোর ডাক দিয়েই শুরু হয়েছিল এবারের নাট্যকোজাগরী। অন্ধকারে রক্তের চোরাস্রোতের বিরুদ্ধে এমনই এক জয়গানের আয়োজন করা হয়েছিল ২৭ মার্চ ২০১৫, শান্তিপুরের পাবলিক লাইব্রেরি রঙ্গমঞ্চে, রাতভোর। আয়োজনে শান্তিপুর সাংস্কৃতিক।
একটা গোটা রাত নাটকের জন্য, সাথে গান, কবিতা, ছবি আঁকা, নাচ — এমনই তো শান্তিপুরের দস্তুর। সেই ২০০২ থেকে।
প্রস্তুতি শুরু হয় এক-দেড় মাস আগে থেকে। সাংস্কৃতিকের নিজস্ব ‘ঘর’-এ সবার হাতে হাতে গড়ে ওঠে কার্ড, স্মারক। যখন আকাশ রাঙিয়ে ওঠে পলাশে, তখনই মনে হয় ‘কোজাগরী এসে গেছে’।
বিশ্ব নাট্য দিবসের সকালে নাটকের জন্য হাঁটা দিয়ে শুরু হয় নাট্যকোজাগরীর যাত্রা। এবারেও পা মেলালেন বহু গুণীজনেরা।
রাত আটটা থেকে মূল অনুষ্ঠান। এবার নাট্যকোজাগরীর মূল সুর ছিল ‘রক্তবিরোধী’। রাত আটটার আবাহনেও ভেসে আসে সেই সুরের অনুরণন। উজান চট্টোপাধ্যায় নির্মিত এই দশ মিনিটের অনুষ্ঠানে ভেসে আসে পেশোয়ারের রক্তাক্ত স্মৃতি। আবাহন শেষ হয় বিশ্ব নাট্য দিবসে নাট্যকোজাগরীর শুভ আমন্ত্রণ দিয়ে। সাংস্কৃতিকের ছোটোদের নিয়ে তৈরি এই অনুষ্ঠানে অভিনয় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
পরের অনুষ্ঠান ছিল অতিথি বরণ এবং সংবর্ধনা। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়, শান্তিপুরের বিধায়ক তথা পৌরপতি; শ্রী অজয় দে, জেলা গ্রন্থাগারিক আধিকারিক; শ্রী মৃত্যুঞ্জয় মিত্র, শিক্ষক তথা শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক শ্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্রী রণজিৎ চক্রবর্তী। এবার সংবর্ধনা দেওয়া হয় শ্রী হরকুমার গুপ্তকে, যিনি চল্লিশ বছর ধরে লেটোর মতো এক বিস্মৃতপ্রায় শিল্পের ধারক বাহক। পরবর্তীতে তিনি এই শিল্পের সামান্য নিদর্শন দেখিয়ে দিয়ে যান, যা দর্শকদের মধ্যে তোলে এক হাস্যরসের ঢেউ। ‘মা’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘কেন না মানুষ’, ‘সাইকেল’-এর মতো নাটকে অভিনয় করা গৌতম মুখোপাধ্যায়কেও সম্মান জানায় শান্তিপুর সাংস্কৃতিক। তাঁর ভাষায় ‘সংবর্ধনা আমি আগেই পেয়ে গিয়েছি’। বাংলার নাট্যজগতের অন্যতম পরিচিত মুখ তীর্থঙ্কর চন্দকেও এবার সম্মান জানানো হয়েছিল শান্তিপুর সাংস্কৃতিকের তরফ থেকে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী সুজাতার অসুস্থতার কারণে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য ২০০২-এ নাট্যকোজাগরীর শুরুর থেকে এই প্রথম তাঁদের অনুপস্থিতি। আমরা আশা করব ২০১৬-তে তাঁদের নিশ্চয় দেখতে পাব।
প্রতিবছরের মতো এবছর বিশ্ব নাট্য দিবসের একটি বাণী দিয়েছেন ক্রিস্তফ ওয়ারলিকাউস্কি।
এরপর মঞ্চস্থ হয় জম্মু ও কাশ্মীরের রঙ্গলোকের ‘মা মুঝে টেগোর বানা দে’। একক অভিনয়ে মাতিয়ে দেন লাকি গুপ্তা। নির্দিষ্ট মঞ্চ তৈরি না করে ছকভাঙা ভাবনাচিন্তা এবং অসাধারণ অভিনয়ে ভর করে দর্শকদের মন কেড়ে নেন লাকি গুপ্তা।
ডল্স থিয়েটারের পুতুল নাটক ‘টেমিং অফ দ্য ওয়াইল্ড’ বাড়িয়ে দেয় নাট্যকোজাগরীর রঙ, বৈচিত্র্য। তাদের তোলা শব্দতরঙ্গের আবহও অসাধারণ। তবে শব্দ এবং মুভমেন্টের তালমিলে আরেকটু দৃষ্টিপাত করলে হয়তো আরও দৃষ্টিনন্দন হত তাদের প্রযোজনা।
সুদূর পশ্চিম মেদিনীপুরের নৃত্যলোক তাদের মুভমেন্টে রঙে রসে জাল বুনেছেন। নৃত্যলোকের প্রদর্শিত রাধা-কৃষ্ণ-সখীদের লীলাখেলা সবারই মন জয় করে।
মধ্যরাতে ঝাড়খণ্ডের দিনকর শর্মার সাবলীল হিন্দিতে গল্প বলা যথারীতি মন কেড়ে নেয়। তাঁর সাথে মুম্বই থেকে আসা জনৈক বন্ধুর কথায় — ‘এখানকার এই একই প্ল্যাটফর্মে এত শিল্পের ধারার এক সুতোয় মিশে যাওয়াই অনন্য।’
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য এখানে অনুষ্ঠান চলার সাথে সাথে চলে শিল্পীদের স্কেচ, কবিদের কবিতা লেখা। সব শেষে ছবি-লেখা তুলে দেওয়া হয় অংশগ্রহণকারীদের হাতে। আবার বাইরে চলে ক্যানভাসে রঙিন তুলির আঁচড়।
এরপর বেথুয়াডহরি রেপুটেড থিয়েটারের নিবেদন ‘মানুষ’ সারা অডিটোরিয়ামে হাস্যরস ছড়িয়ে দেয়। কল্যাণী, সৃজনের নৃত্য পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন তোলে, যা আমাদের ভাবায়, কাঁদায়।
কলকাতার নতুন দল ‘নির্ণয়’-এর দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘নয়নচাঁদের ব্যবসা’-কে এককথায় বলা যায় অসাধারণ। তাদের নাটকে একদিকে ছিল বর্তমান সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে শানানো আক্রমণ। যদিও সবটাই যথেষ্ট হাসির উদ্রেক ঘটায়।
রাত তিনটে কুড়িতে লোকগান দর্শকদের মধ্যে অনুরণন ফেলে দেয়। শান্তিপুরের বিখ্যাত শিক্ষক তথা সংগীতশিল্পী ব্রহ্মদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘শুধু পাশ্চাত্য সংগীত নয়, বাংলার মাটির গন্ধ মাখা লোকগানও যে মানুষের মধ্যে আলোড়ন ফেলতে পারে তার প্রমাণ আজ পেলাম।’
এরপর চিত্রকর, কবি, নেপথ্যের মানুষদের স্মারক প্রদান করা হয়। সারা রাত জুড়ে আঁকা ছবির মধ্যে দীপঙ্কর পাড়ুই, শিবশঙ্কর দাস, অরুণ সরকার, সুমিত দাস, তুলিন মল্লিক, অখিলেশ রায়, শ্যামচাঁদ প্রামাণিকের ছবি চোখ টানে। কানে বাজে পনেরোটা ছবি নিয়ে লেখা শুভাশিস সামন্তের কবিতা। অসাধারণ অথচ সাধারণ বহিঃসজ্জা মন জুড়িয়ে দেয়। বাইরে মাঠে তাঁবুতে ‘কলস’-এর স্টল লোকশিল্পের সহজ কথাকে তুলে ধরে।
এখানে উল্লেখ্য প্রকাশ পেয়েছে শান্তিপুর সাংস্কৃতিক তথা থিয়েট্রিক্যালের স্বপ্নের সংকলন ‘মহলা’। এখানে বাংলা, ভারত তথা পৃথিবীর গুণীজনদের লেখা সংকলিত হয়েছে। এই উদ্যোগের অন্যতম হোতা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের কথায় — ‘এই বই ভবিষ্যতে নাট্যচর্চার রসদ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে।’ সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় কৌশিক চক্রবর্তী এবং অনিন্দ্য মোদক নিজস্বতার ছাপ রাখে।
সব শেষে ভোর হয়। শুরু হয় ভোরের গান। মৌমিতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে। ভোর আসে। নাট্যকোজাগরী ২০১৪ শেষ হয়। পরের বারের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা। অনেকে বলে ওঠে, আর তো মাত্র ৩৬৪ দিন। ব্যস! নাটকের জন্য একটা রাত জাগা। জাগিয়ে রাখা। অসাধারণ। আমরা অনেকটা সমৃদ্ধ হই। অনিন্দ্য মোদকের কবিতায় —
সারাটা রাত জুড়ে ঘুমোয় যারা
জানি, দিনেও ঘুমোয় তারা।
Leave a Reply