দীপঙ্কর সরকার, ঢাকুরিয়া ইস্ট রোড, হালতু#
অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ বারো বছর কেটেছিল (১৯২৬-৩৮) দেউলটির সামতারের গ্রামে, পোঃ পানিত্রাশ, জেলা হাওড়া। কলকাতা থেকে দেউলটি ৬০ কিমি। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩, রবিবার হাওড়া থেকে ভোর ৫টা ৫০মি. পাশকুড়া লোকালে চেপে বসলাম। ট্রেনে ভিড় কমই ছিল। ৭টা নাগাদ দেউলটির স্টেশনে লামলাম। নেমে হাঁটতে হাঁটতে বোম্বে রোড ৬নং জাতীয় সড়কে এসে পৌঁছালাম। পার হয়ে উল্টো দিকে একটা কাঁচা-পাকা রাস্তা চলে গেছে সামতারের গ্রাম পানিত্রাশ। জাতীয় সড়ক মোড় থেকে তিন কিমি রাস্তা ভিতরের দিকে রূপনারায়ণের কাছে। মোড় থেকে ডানদিকে বাগনান স্টেশন যাওয়া যায় অটোতে। বাঁদিকে কোলাঘাট। মোড়ের মাথা থেকে ভ্যান রিক্সায় যাওয়া শরৎচন্দ্রের বাড়ি। মোড়ে দিকনির্দেশ আছে সাইনবোর্ডে। ১০ মি. যাওয়ার পর একটা মোড়ে রিক্সা থেকে নেমে পড়লাম। তারপর একটু হেঁটে শরৎচন্দ্রের বাড়ি। কাঠের তৈরি সুন্দর গেট। গেটের সামনেই বাঁধানো ঘাট পুকুর। গেট খুলেই দেখি পুরাতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ড। হেরিটেজ কমিটি সংরক্ষিত সংগ্রহশালা দোতলায়। সেখানে চিত্তরঞ্জন দাশের দেওয়া রাধাকৃষ্ণের মুর্তি যা এখন পুজা হচ্ছে। একটা পেন্ডুলাম যুক্ত ঘড়ি যা এখনও নিয়মিত চলছে। হোমিওপ্যাথি ঔষধ রাখার আলমারি, শোয়ার বিছানা, চেয়ার ইত্যাদি। সংগ্রহশালার বাড়ির পিছনে ধানের গোলা। বাড়িটা ১০-১২ কাঠার মতো জায়গা নিয়ে মধ্যেখানে। চারিদিক গাছপালা ভর্তি। ছায়ানীড় পরিবেশ। গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা পেয়ারা গাছ। গাছটি প্রায় ৭২ বছর পুরোনো। তারপরের বাড়িটি বর্মার প্যাগোডার ধাঁচে তৈরি দোতলা বাড়ি, বাড়িটি এখনও শক্ত-পোক্ত তেমনটিই আছে। প্রত্যহ মোছা হয় ও পরিষ্কার করা হয়। সব কাজ করেন একলা দুলালবাবু। বয়স ষাটের কাছে। উনি অবিবাহিত। কাছেই থাকেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কত মাইনে পান? বললেন শরৎচন্দ্রের ভাইপো জয় চট্টোপাধ্যায় ৫০০ টাকা মাসে দেন। সরকার থেকে কিছু পান না। যাই হোক এখনও তিনি পরম স্নেহে অন্তরের ভাললাগা থেকে এই সংগ্রহশালা দেখাশোনা করে যাচ্ছেন। বাড়িটার বারান্দায় একটা পাখির মাচা আছে।
সারাদিন নিঃস্তব্ধ পরিবেশে কিচির মিচির শব্দ হচ্ছে। বারান্দায় রেলিং কাঠের তৈরি। বারান্দা থেকে দূরে দেখা যায় রূপনারায়ণ বয়ে যাচ্ছে। নদীর তীরে গরু-ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। বারান্দায় শরৎচন্দ্রের আবক্ষ মুর্তি স্থাপিত আছে। পাশেই প্রাচীর ঘেরা একটি জায়গায় তিনটি সমাধিক্ষেত্র আছে। তাতে শায়িত আছেন শরৎচন্দ্র, মেজভাই বেদানন্দ (জন্ম আষাঢ় ১৯২৪, মৃত্যু ১০ কার্তিক, ১৩৬৭)। শরৎচন্দ্রের স্ত্রী হিরন্ময়ী দেবী (মৃত্যু ১৫ই ভাদ্র, ১৩৬৭)। শরৎচন্দ্রের জন্ম ১৭ই সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজার দিন।
১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত শেষ বারো বছর তিনি এখানেই কাটিয়েছেন। বিপ্লবীরা সব এখানে আসতেন ও তাঁদের সাথে তিনি সভা করতেন। টালির চাল আর কড়ি বরগার সঙ্গে চক মেলানো মসৃণ বারান্দায় মোড়া বাড়িটার দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে নিচের গোলঘর, ঠাকুরঘর, খিড়কির দরজা সব নজরে পড়ে।\par
বিশ্বকর্মা পুজার দিন এই বাড়িতে শরৎমেলা বসে। এখানেই তিনি লেখেন কালজয়ী বিপ্রদাস, পল্লীসমাজ ও অভাগীর স্বর্গ উপন্যাস।
বাড়িটার পিছন দিক বাঁশঝাড় ও লালমাটির রাস্তা। সেখান থেকে পাশ দিয়ে দু-দিকে ধানখেতের মধ্যে মাটির উঁচু সরু আলপথ দিয়ে রূপনারায়ণের ধারে যাওয়া যায়। সেখানে আদিগন্ত রূপনারায়ণ বয়ে চলেছে। নদীর পার ভেঙ্গে গিয়েছে। পাশেই জঙ্গলে বসে নদীর নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করলাম ও ক্যামেরায় ছবি তুললাম। এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সেখান থেকে ফিরে এসে বাড়ির গেটের সামনে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির ছবি তুললাম। সামনের পুকুরে কার্তিক, গণেশ নামের দুটো মাছ। রামের সুমতিতে আছে মাছ দুটির নাকে নোলক পরানো থাকত। ২০০৭ সালে এই বাড়ি ঐতিহ্য ভবন হিসাবে ঘোষিত হয়। এখনও পরম যত্নে এই বাড়ি দেখাশোনা হয়। আগামী প্রজন্ম বহু বৎসর ধরে অমর কথাশিল্পীর স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়ি দেখতে পারবে। একটা অনবদ্য ভালোলাগার পরশ নিয়ে ভবিষ্যতের পাথেয় সঞ্চয় করে।
Leave a Reply