অলকেশ মণ্ডল, বাগনান, হাওড়া, ৪ অক্টোবর#
৪ অক্টোবর হুগলির খানাকুল থানার হরিশচক গ্রাম থেকে আমাদের কাছে একটা খবর আসে। মুণ্ডেশ্বরী নদীর ধারে কোলেপাড়ায় গ্রামের লোক তিনজন সাপুড়েকে ধরে রেখেছিল। এই সাপুড়েরা ওই গ্রামে এর আগেও বারবার এসেছে। এরা বিভিন্ন লোকের বাড়ি থেকে সাপ উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। বিনিময়ে এক–দুই–তিন এমনকী চারহাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এবারে ওইদিন ওরকমই সাপ উদ্ধার করতে এসে ওরা ছয়হাজার টাকা দাবি করে। কিছু সাপ ওরা উদ্ধার করে, যেগুলো কেউটে সাপ। গ্রামের মানুষের সন্দেহ হয়, সাপগুলো হয়তো ওখানে ছিল না, ওরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল। সেই সাপগুলো ওখানে ছেড়ে দিয়ে উদ্ধারের অভিনয় করে টাকা হাতানোর চেষ্টা করছিল। এইরকম পরিস্থিতিতে গ্রামের লোক আমাদের ডেকে পাঠায়। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির বাগনান শাখার শুভেন্দুর (সে সাপ নিয়ে কাজ করে) কাছে গ্রামের লোক প্রথমে খবর দেয়। খবর পেয়ে আমরা দুজন মোটরসাইকেলে করে ওই গ্রামে যাই।
আমাদের সংগ্রহে থাকা দু–চারটে বিষধর সাপ সঙ্গে নিয়ে যাই, যদি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। সাপুড়েদের গ্রামের মানুষ ধরে রেখেছিল আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, আমরা কখন পৌঁছাব। দুপুর আড়াইটে নাগাদ ওখানে পৌঁছে আমরা দেখি প্রায় হাজার দুয়েক লোক জড়ো হয়েছে। সকলের সামনে প্রমাণ করতে হবে, সাপগুলো সদ্য ধরা হয়েছে না ওদের কাছে আগেই ছিল। যদি প্রমাণিত হয়, সাপগুলো ওদের কাছেই আগে ছিল, তাহলে লোকের এতই আক্রোশ যে ওদের পিটিয়ে মেরেও ফেলতে পারে। তেমন ধরনের কথাবার্তাও হচ্ছিল ওখানে। আমাদের তখন দুটো কাজ — এক, ওরা যদি প্রতারক হয়, ওদের প্রতারক প্রমাণ করা এবং গ্রামবাসীর আক্রোশ থেকে ওদের বাঁচানো। মুণ্ডেশ্বরী নদীর ওপরে বালির চরায় ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়ো জায়গা আছে। সেই চরায় সাপগুলো ফেলে আমরা দেখতে শুরু করি। মানুষ চারপাশে দাঁড়িয়ে যায়। দেখা যায়, একটা সাপের দাঁত ভেঙে তার মুখ ওরা ক্ষতবিক্ষত করেছে এবং দাঁতগুলো ভেঙেছে যাতে বোঝা অসুবিধা হয় যে সাপগুলো সদ্য ধরা না আগে ধরা। আমরা দাঁতগুলো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি, রক্তের উৎস দাঁত ভাঙা থেকে নয়, চোয়ালের অন্য জায়গা ওরা কেটে দিয়েছে। লোকে যখন চ্যালেঞ্জ করেছে, তখন ওরা নিজেদের বাঁচাতে এই কাণ্ডটা করেছে। দ্বিতীয় সাপটির দাঁত আগে থেকেই ভাঙা। গ্রামের মানুষকে বলি, আমরা জানি ওরা প্রতারক, কিন্তু ওদের গায়ে হাত দেওয়া চলবে না। গ্রামের দু–তিনজন ছেলে, যারা বিষয়টাতে মাথা দিচ্ছিল, তাদের আলাদা করে ডেকে বোঝাই। ওরা সম্মত হয়, বলে, ঠিক আছে, যা ভুল আমরা করেছি হয়ে গেছে, এখন আমাদের চেতনা হল। সাপগুলোকে চিহ্নিত করা গেল। ওদের কাছে একটা ব্যাগে যে সামগ্রী ছিল, তাতে হাড়, শিকড়, নানারকম পুঁথি, কবচ, এমনকী মেটালিক সোডিয়াম — যেটা ম্যাজিসিয়ানরা ব্যবহার করে এবং যেটা জলে ফেললে আগুন জ্বলে ওঠে — উদ্ধার হয়। সব বাজেয়াপ্ত করে ওদের হাত দিয়েই সেগুলো জলে ফেলে দেওয়া হয়।
সাপুড়েদের মধ্যে একজন বেশ বয়স্ক, ষাটের কোঠায় বয়স হবে, নাম নিমাই পাল; আর একজন পঞ্চাশের ওপর বয়স, নাম শিশির মাল; তৃতীয়জন শিশির মালের ছেলে হাকিম মাল, ডাকনাম ফটিক, ২২–২৫ বছর বয়স। ওরা থরথর করে কাঁপছিল। আমাদের কাছে প্রার্থনা করে, আমাদের বাঁচান। আমরা বলি, আপনারা গ্রামের লোকের কাছে স্বীকার করুন। ওরা দেখে সত্য ফাঁস হয়ে গেছে। তাই ওরা স্বীকার করে নেয়, সাপ দুটো আমরা সঙ্গে করে এনেছিলাম। যাদের বাড়ি থেকে ওরা আগেও টাকা নিয়ে গেছে, এরকম দু–একজন এগিয়ে এসে ওদের একটু চড়–থাপ্পড় মারে। টাকা ফেরত দেওয়ার কথা হয়। আমরা বলি, আপনারা ওদের সঙ্গে আলোচনা করুন, ওদের বাড়িতে যান। সাপুড়েরা থাকে আরামবাগের পুড়শুরা গ্রামে। যাই হোক, গ্রামের ছেলেদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তারা ওদের বাঁচিয়ে নিরাপদ দূরত্ব পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। তবে সাপুড়েরা বলে গেছে, আগামীদিনে সাপের খবর হলে ওরা আসবে। আমরাও বলেছি, হাজার টাকা দাবি করা চলবে না। একদিনের মজুরি নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা আর থানা–পুলিসের রাস্তায় যাইনি। ওরা কথা দিয়েছে, আর প্রতারণা করবে না। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, আমাদের বাড়ি উল্টোদিকে। আমরা আর দেরি না করে ফিরে আসি।
Tapan Chanda says
LIKES.