সাইকেল চালক রঞ্জন গোস্বামীর বয়ান
আমি টালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিক থেকে আসছিলাম, রাসবিহারীর দিকে যাচ্ছি। টালিগঞ্জ থানার সামনেটা ক্রস করে দাঁড়িয়ে আছি। ফুটপাথের ওপর ওরা প্লেন ড্রেসে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হেঁটে হেঁটে পাস করছি, ওরা দৌড়ে দৌড়ে আমাকে ধরেছে। ধরাটাও অপমানজনক। যেন আমরা চুরির দায়ে ধরা পড়েছি। আমি বললাম, আপনারা ধরবেন না, আমি থানায় যাচ্ছি। আমি থানায় নিজেই যাব।
থানার সামনে একটা টেবিলের ওপর অফিসাররা বসে আছে ড্রেস পরে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সাইকেলের ফাইন কোথায় জমা দিতে হয়? বলল, ওই ভেতরে চলে যান, ওখানে দেবেন। ওখানে কিছু মানুষ আছে, যারা ইউনিফর্ম পরে নেই। খাতা নিয়ে বসে আছে। আমি বললাম, এখানে জমা দিতে হয়? বলল, হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কত দিতে হয়? বলল, একশো টাকা দিতে হয়। আমি বললাম, একশো টাকা নিন। রসিদ আমাকে দিতে হবে একটা। বলল, না আমরা তো রসিদ দেব না। আমি বললাম, রসিদ নেব। তো, এই নিয়ে খানিক তর্ক হল। বললাম, কী করতে হবে? বলল, তাহলে কোর্টে গিয়ে ছাড়াতে হবে। আমি বললাম, সে ঠিক আছে। আমাকে বলল, কেস লিখব। তখন অন্য মেজাজ। যেই বলেছি কোর্টে যাব, অন্য মেজাজে কথা বলছে। বললাম, দেখুন সাইকেল নিয়ে মুভমেন্ট হচ্ছে, পেপারে আমরা পড়েছি। সাইকেল লেন করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। (আমাদের তখন আপনাদের সঙ্গে আলাপ হয়নি। পেপারে যা পড়া। এই নিয়ে আমার বহুদিনের ভাবনা, যোগাযোগ করার ব্যাপারে।)
তো ওরা কেস লিখল। কেস লেখার পরে তখন আমি তো দিশেহারা, কী করব। আমার এক বন্ধু আছে, যে কমিশনারের চেনাশোনা। আমায় বলল, কেস ফেসে যাস না, আমি বলে দিচ্ছি, ও আমার বন্ধু, বললে পয়সা লাগবে না, ছেড়ে দেবে। আমি ভাবলাম, কমিশনারকে বলা আর একশো টাকা দেওয়াটা একই ব্যাপার। কারোর সুপারিশে ছাড়ানো …। আমি বললাম, দরকার নেই। কোর্টেই যাব।
আলিপুর পুলিশ কোর্টে গেলাম। থানা থেকে আমাকে বলে দিয়েছিল, আপনি দুটোর পরে যাবেন। কোর্টের দিন আমি কী করব, দিশেহারা। সাইকেল কমিটির একজন আছেন, আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তাঁকে পেলাম না। পাড়ার এক উকিলের কাছে গেলাম, তো ওরা বলল, খুব ব্যস্ত। গুরুত্ব দিল না। সাইকেলের কেস মানে গুরুত্বহীন কেস। বলল, ওখানে আপনি চলে যান, অনেক উকিল পেয়ে যাবেন। অনেক উকিল বসে আছে, ধরে নেবেন একটা।
তারপর হঠাৎ আমি সার্চ করে সাইকেল র্যালির নাম্বারটা পেয়ে গেলাম। রঘু জানা। কোনো কারণে টুকেছিলাম নাম্বারটা। চৌরাস্তায়। কনটাক্ট করতেই সিরিয়াস রেসপন্স। অনেকে বলে, না দেখছি দেখব। আচ্ছা চেষ্টা করছি। উনি বললেন, চ্ছ্রআচ্ছা আপনি কখন কোর্টে আসবেন?’ বললাম, কালকে দুটোর মধ্যে যেতে বলেছে। ‘দুটোর পরে। ঠিক আছে।’ প্রচুর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উনি গেলেন। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। এইজন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। আমার জন্য উনি গেছেন। আরেকজন শমীকদা গেলেন, আমার সাপোর্ট হল মনে।
তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমরা কোর্টে জিআর সেকশন পেলাম। তখন ওদের কথাবার্তা, না এখন তো হবে না। দুটো বেজে গেছে। এখন তো হবে না। এদিকে ওরাই বলল, দুটোর পরে যেতে। তখন ভাবটা একটু অন্য ভাব। মানে ডোন্ট কেয়ার ভাব। দেখো একটা স্লিপ এসেছে টালিগঞ্জ থানা থেকে, প্রথমে বলল, কাগজ আসেনি। তারপর বলল, হ্যাঁ, একটা কাগজ এসেছে। টালিগঞ্জ থানা থেকে একটাই কাগজ এসেছে। সাইকেলের একটাই কেস এসেছে। তারপর বলল যে, আপনি আগামী কাল এগারোটা বারোটার মধ্যে আসবেন। আমি বললাম, একজ্যাক্ট টাইমটা বলুন, সাড়ে এগারোটা না বারোটা? সাড়ে এগারোটা।
পরের দিন আবার রঘুদা এলেন। উনি একা এলেন অবশ্য। আবার গেলাম। আগের দিন যে মুহুরিকে বলেছিলেন, মুহুরিবাবু বোধহয় আশি টাকা নেবেন বলেছিলেন। যাক গে। রঘুদার দুই চেনা উকিল ছিলেন। যেই উকিলরা এলেন, ওদের পুরো মোটিভ বদলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে। হাসিখুশি হয়ে গেল। বলে, কী করব, উপায় নেই। এই সাইকেল ধরে। উকিলবাবুরা জানতে চাইলেন, কী জন্য কেস দিয়েছে? আগে আমাদের সাথে অত ভালো ব্যবহার করছিলেন না। ওনারা যেই গেলেন, বলে হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাদের চিন্তা নেই এক্ষুনি করে দিচ্ছি। কোনো ব্যাপার না। কী করব, একগাদা ফাইল, বলে আলমারিতে একগাদা ফাইল দেখালেন। তারপর ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট যিনি আছেন, নামটা ভুলে গেছি আমি — উনি বললেন, চারটের সময় আপনি আসুন।
রঘুদা বেরিয়ে গেলেন, আমি বসে থাকলাম। চারটের সময় উনি আমাকে মানি রিসিট কপিটা দিলেন। তারপর ওটা নিয়ে টালিগঞ্জ থানায় গেলাম। থানায় সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং যেটা হয়েছে, থানায় যাওয়ার পর, অফিসার বলছেন, তখন বাজে সন্ধ্যে ছ’টা, কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়েছি বিকেল পাঁচটায়। থানায় ছ-টায় পৌঁছোলে অফিসার বলছেন, এখন তো সাইকেলের লোকেরা চলে গেছে, এখন তো সাইকেলটা দেবে না, আপনি কালকে নিন। মুড়ি খাচ্ছেন আর বলছেন। আমি বললাম, আমার বাড়ি পাশেই, মহাবীরতলায়। আপনি কাল কেন, পরশু দিন। যারা আমার সঙ্গে ছিলেন, তাদেরকে জানিয়ে দেব, আপনি আমায় সাইকেলটা দেননি। বলার পরেই, মুড়ি ফুড়ি খাওয়া বন্ধ করে খাতা ফাতা বার করে সাইকেলটা বার করে দিলেন। তারপর বলছেন, আমরা গরমেন্টের চাকর, কী করব বলুন তো। আমাদের ডিউটি। উপায় নেই। আমাদেরও ভালো লাগে না। আমাদেরও ধরতে হয়। কলকাতায় জায়গার তুলনায় ত্রিশ শতাংশ রাস্তা। উপায় নেই। আমি বললাম, ঠিক আছে। সাইকেলটা পেলাম। ধন্যবাদ।
কোর্ট কুড়ি টাকা নিল। আর পিটিশন কপিটা বাইশ টাকা। ব্যস্ বিয়াল্লিশ টাকা মোট। উকিল যাঁরা ছিলেন, তাঁরা চেনা বলে কোনো পয়সা নিলেন না, তবে আমি চা খাওয়ার জন্য কিছু দিয়েছি। সে আলাদা কথা।
এরপর উকিল বন্ধু প্রসূন বললেন, ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাফিক রেগুলেশন অ্যাক্ট, (১৯৬৫)-এ কেসটা দিয়েছে। এবং এটাতে কুড়ি টাকাই ফাইন নিয়েছে। আর পেশকারদের টাকা দিতে হয় কিছু, তার জন্য পঞ্চাশ টাকা নিয়েছে। কেসের সার্টিফায়েড কপি তোলা হয়েছে। তাতে লেখা আছে — চার্জড দ্যাট দিস পারসন প্লাইং উইথ বাইসাইকেল ইন টালিগঞ্জ পুলিশ স্টেশন এরিয়া, দ্যাট ইজ এসপি মুখার্জি রোড অ্যান্ড সাদার্ন এভেনিউ ক্রসিং অন টোয়েন্টি নাইনথ জুন টু থাউজেন্ড ফিফটিন ইন বিটুইন টেন থার্টি টু টুয়েল্ভ থার্টি ফর কজিং অবস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডিসটার্বেন্স দ্য নর্মাল ফ্লো অফ ট্রাফিক। অ্যাজ সাচ হি ইজ প্রসিকিউটেড অন দ্য রুল ফাইভ অফ দ্য অ্যাক্ট অব …। (এই লোকটি টালিগঞ্জ থানা সংলগ্ন এলাকায় এসপি মুখার্জি রোড এবং সাদার্ন এভেনিউ ক্রসিংয়ে ২৯ জুন তারিখে সাইকেল নিয়ে ঘুরছিল সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে এবং ট্রাফিকের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করছিল, তাই তাকে উক্ত আইনের পাঁচ নম্বর ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হল।)
Leave a Reply