সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ২৮ নভেম্বর#
২৬ নভেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল কমিশনার সৌমেন মিত্র-র সঙ্গে সাইকেল সমাজ সহ কয়েকটি সংগঠনের বৈঠক হয় লালবাজারে। সেই বৈঠকে সাইকেল সমাজের পক্ষ থেকে কমিশনারের কাছে দাবি জানানো হয়, ১) অবিলম্বে কলকাতার সমস্ত রাস্তা থেকে নিঃশর্তভাবে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা (সাইকেল সহ সমস্ত অযন্ত্রচালিত যানবাহনের ওপর) প্রত্যাহার করতে হবে। ২) কলকাতার রাস্তায় যানজটের সমস্যার সমাধানে রাজ্য সরকার একটি কমিটি তৈরি করুক, তাতে বিশেষজ্ঞ, কলকাতার রাস্তায় যারা সাইকেল চালায় তারা, এবং ট্রাফিক ডিপার্টমেন্টগুলো থাকুক। এছাড়া সাইকেল সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কম সময়ে কলকাতার রাস্তায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম সাইকেল। সেই মাধ্যমটিকে ১৭৪ টি রাস্তায় নিষেধ করা (৪০ এর বেশি রাস্তায় ২৪ ঘন্টার জন্য, ১১৭টি রাস্তায় সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা) মানে কলকাতার রাস্তা থেকে সাধারণ মানুষকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া। সাইকেল সমাজের পক্ষ থেকে এন্টালিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের সময় সাধারণ সাইকেল আরোহীরা জানিয়েছিলেন, ‘যদি বড়ো রাস্তায় সাইকেল নিষেধ করে দেয় পুলিশ, তাহলে গলি রাস্তায় গাড়ি নিষেধ করে দেবে জনগণ।’ এই কথাটাও পুলিশ কমিশনারকে শুনিয়ে দেওয়া হয়।
ভবানীপুর যদুবাজার অঞ্চলের সাইকেল আরোহী জীবিকা অধিকার রক্ষা কমিটি-র পক্ষ থেকে গোয়ালা, ছোটো ব্যবসায়ী সহ বিভিন্ন সাইকেলজীবী মানুষেরা ছিলেন বৈঠকে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয় — এই সংগঠনের পক্ষ থেকে দু-বছর আগে কলকাতা পুলিশকে একটি ম্যাপ দেওয়া হয়েছিল, তাতে কোথায় কোথায় সাইকেল লেন হতে পারে, তার বর্ণনা দেওয়া ছিল। এই ম্যাপ তৈরি করার কথা বলেছিল কলকাতা পুলিশই (দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়)। কিন্তু এতদিনেও সেসব কিছু করা হয়নি। উল্টে ৩৮টি রাস্তায় সাইকেল নিষেধ ছিল আগে, সরকার বদলের পর তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ১৭৪টি রাস্তায়। অথচ সাইকেল স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবশ্যিক একটা পরিবহণ মাধ্যম। তেল সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধির যুগে সাইকেল অনস্বীকার্য। প্রয়োজনে সাইকেল চালকদের জন্য কলকাতা পুলিশ সচেতনতা সপ্তাহ আয়োজন করতে পারে।
পাবলিক নামক সংগঠনের তরফে প্রদীপ কক্কর বলেন, কলকাতা শহরের হাওয়া বাতাসের যা অবস্থা তাতে সাইকেল-এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও তর্কই চলতে পারে না। তাছাড়া কলকাতা পুলিশ রাস্তায় যানবাহনের গতির ভিত্তিতে কলকাতার সড়ক পরিবহণকে ভাগ করছে — সেই ভাগাভাগিতে একদম শেষে আসছে সাইকেল সহ সমস্ত অযন্ত্রচালিত যান। এই ভাগাভাগি সম্পূর্ণ ভুল। কলকাতা পুলিশের সচেষ্ট হওয়া উচিত রাস্তা থেকে প্রাইভেট গাড়ি কমানোর জন্য। কলকাতা যে ফুসফুসের অসুখের রাজধানী হয়ে উঠছে বায়ুদূষণের জন্য, সে ব্যাপারে কলকাতা পুলিশ নিশ্চয়ই অবগত আছে।
রাইড টু ব্রিদ সংগঠনের গৌতম শ্রফ বলেন, কলকাতার সাধারণ সাইকেল ও অযন্ত্রচালিত যানের ওপর নির্ভর করে যারা, তাদের ভাত মারার এই চেষ্টা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমি কলকাতাবাসী বলে আমার লজ্জা হচ্ছে।
সুইচ অন সংগঠনের একতা জাজু বলেন, কলকাতা পুলিশ অবিলম্বে নিঃশর্তে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিক।
বৈঠকে চক্র সত্যাগ্রহ মঞ্চের তরফে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগৃহিত প্রায় ২৫ হাজার স্বাক্ষর কলকাতা পুলিশের হাতে তুলে দেন একতা জাজু। শমীক সরকার সাইকেল সমাজ সংগঠনের তরফে রাস্তায় সংগৃহিত প্রায় আড়াই হাজার স্বাক্ষর জমা দেন।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্যের আগে ও পরে প্রায় আধঘন্টা বক্তব্য রাখেন স্পেশাল পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র স্বয়ং। সেই বক্তব্যে তিনি জানান,
১) সাইকেল ও অযন্ত্রচালিত যান নিষেধ করা হয়নি, নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে মাত্র।
২) কলকাতায় রাস্তা তুলনায় কম, ফলে ট্রাফিক চ্যালেঞ্জ বেশি।
৩) প্রতি বছর কলকাতায় চারশ’ সাড়ে চারশ’ লোক অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। সাইকেল আরোহীদের জন্য দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছি, তা থেকে ছবি পাচ্ছি। সেগুলি আমরা ইউটিউবে তুলে দিয়ে দেখিয়ে দেব সাইকেলের জন্য দুর্ঘটনা ঘটে।
৪) কলকাতা পুলিশ রাস্তায় প্রাধান্য দেয় যথাক্রমে মেট্রো, বাস, মিনিবাস; তারপর প্রাইভেট গাড়ি; তারপর হাতে টানা রিকশা প্রভৃতি; তারপর মোটর সাইকেল; তারপর সাইকেল।
৫) সাইকেল লেন করতে পারলে ভালো হত, কিন্তু রাস্তা এত কম যে করতে পারা যাচ্ছে না।
৬) প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে কলকাতা পুলিশ ভাবনা চিন্তা করেছে, কিন্তু কিছুই কার্যকর করা যায়নি।
৭) তিন রকম লোকেরা সাইকেল চালায় : ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সাইকেলপ্রেমী, কাজের জায়গায় সাইকেলে যায় যারা (ক্ষুদ্র সংখ্যক)
৮) কলকাতা পুলিশের পরিকল্পনা : মেইন রাস্তা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ও বড়ো গাড়ির জন্য (প্রাইভেট গাড়ি সহ); অটো, রিক্সা, সাইকেল, ভ্যান, ম্যাটাডোর — এগুলো রেল বা মেট্রো স্টেশন থেকে বড়ো রাস্তায় নিয়ে যাবে লোকেদের। বড়ো রাস্তায় এগুলো চলতে পারবে না, ক্রসিং পেরোতে পারবে; সাইড লেন বা বাইলেন দিয়ে সাইকেল বা অন্যান্য ধীরগতির যান চলতে পারবে।
সৌমেন মিত্রর বলা শেষ হয়ে গেলে আন্দোলনকারীরা তাঁর প্রতিটি পয়েন্টকে খন্ডন করতে চান যুক্তি দিয়ে, কিন্তু তার কোনও সময় না দিয়ে স্পেশ্যাল পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র মিটিং থেকে বেরিয়ে যান।
Leave a Reply