অমিতাভ সেন, কলকাতা, ২২ আগস্ট#
— এটা কি ওভারব্রীজ ? না; ওই তো ট্রেনের লাইন দেখছি, এই লাইনটা কোথায় গেছে?
আমার পেছনের সীটে বসা যাত্রীর প্রশ্ন শুনে বললাম,
— এটা দক্ষিণের লাইন — সোনারপুর হয়ে ক্যানিং, ডায়মন্ডহারবার — ওইসবদিকে গেছে। এসডি ১৬ বাস তখন সুকান্ত সেতুতে উঠছে। আমার পাশের সিটের যাত্রী বললেন,
— আমরা এদিকে রাসবিহারীর মোড়ের বেশি আসিনি আগে।
— আপনারা কোত্থেকে আসছে?
— আমতলা, ডায়মন্ডহারবার লাইনে, ওদিকে বাস রাস্তা আছে। ট্রেনের লাইন আছে শুনেছি, দেখিনি। এটা কোন স্টেশন?
— যাদবপুর। এদিকে কোথায় এসছিলেন?
— হাসপাতালে। পিয়ারলেস হাসপাতাল।
— এতদূর আসতে হল?
— ইএসআই এখানে পাঠিয়েছে। ছেলের গলায় অপারেশন। দেড় বছরের ছেলে। তাকে খাবার খাওয়ালে নাক দিয়ে বেইরে যাচ্ছিল। জন্মের পর থেকেই ওরকম। ডাক্তার বলল, ছেলে বাবা-মা ডাকার আগেই আনলে ভালো; আবার বলল, দশ কিলো ওজন না হলে অপারেশন করা যাবে না। বোঝো কী করব? আজ অপারেশন হয়েছে। ছেলের মা রয়েছে ছেলের সাথে। ডাক্তার বলল, ভালোই আছে। অক্সিজেন দেওয়া আছে।
আমার আর পাশের যাত্রীর কথাবার্তার মধ্যেই পেছনের যাত্রীর হলা, ওই দ্যাখ ওটা কোনও পার্ক মনে হয়। পেছনের যাত্রীর হাতের আঙ্গুল জানলার বাইরে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাড়ানো। আমি বললাম, না ওটা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। পেছনের যাত্রী একটু বেশি সরল। অনেক কথা বলেন,
— জানো, আমরা একটা বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছিলাম। ড়াতে গেছলাম। নালন্দা না কী নাম বলল। একেবারে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখেছে। কোনও উন্নয়ন নেই। — বললাম,
— ওটা অনেক পুরনো সময়ে ছিল। তা হবে। খালি পাথর। সে যে কী বড়ো বড়ো। এখন খালি জঙ্গল। তাই দেখতেই পাঁচটাকা করে টিকিট নিয়ে নিল।
পাশের যাত্রীর সঙ্গে গল্প করে জানলাম, ওরা থাকে আমতলা থেকে একটু ভেতরে। কাজ করে সেঞ্চুরি প্লাইউড কারখানায়। কারখানা ঠাকুরপুকুর থেকে একটু দূরে। ওরা সাইকেল চালিয়ে আসে বাড়ি থেকে। দু-শিফটে কাজ হয়। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা। আবার সন্ধ্যে ৬টা থেকে সকাল ৬টা। ছ-হাজার লোক কাজ করে। ওদের মজুরি ৩৫০ টাকা রোজ। সপ্তাহে একদিন ছুটি, রবিবারে। তা বাদে বছরে ১৪ দিন ছুটি। আর অসুখ করলে ডাক্তারকে লিখিয়ে ছুটি পাওয়া যায়। পাশের সহযাত্রীর ভাষায়,
— শরীর খারাপ থাকলে ছুটি তো দিতেই হবে? কাজ করব কী করে অসুখ নিয়ে। খাটনি আছে না?
— হ্যাঁ, ১২ ঘন্টা করে কাজ তো, বলে আমি সায় দিই। শ্রমিকটি হাসেন,
— ১২ ঘন্টা কিন্তু খাতায় কলমে ৮ ঘন্টা। অনেক দু-নম্বরি ধান্দা আছে কারবারে।
— মালিক কি বাঙালি?
— নাঃ, কী জানি না। তবে অবাঙালি।
— ইউনিয়ন আছে? হ্যাঁ হ্যাঁ, সব পার্টির ইউনিয়ন আছে। অত লোক কাজ করে, কেউ ছাড়ে! ওই পার্টির লোকগুলোই বেশি খচ্চর। বরং মালিক ভালো। ম্যানেজারও ভালো।
আমি অবাক হয়ে শুনি। একটু আগে মালিকের দু-নম্বরি ধান্দার কথা বলল। তারপর ভাবি, পার্টির ইউনিয়নগুলো বোধহয় আরো বেশি, তিন নম্বরি ধান্দা কিছু করে ওখানে। পেছনের সহযাত্রীর গলা শুনতে পাই, দোকান জামাকাপড়ের — সেলাই — সেই তখন থেকেই চলছে।
বাসটা গড়িয়াহাট পেরিয়ে লেকমার্কেটের কাছে চলে এসেছে, সেখানে আমায় নামতে হবে। আমায় উঠতে দেখে সহযাত্রী শ্রমিকরা বলে, আপনি এখানে থাকেন? নাঃ আরেকটু এগিয়ে, বলে আমি বাসের দরজার দিকে এগোই। পেছনে তাকিয়ে দেখি ওরা নিবিষ্ট মনে ঝলমলে আলো লাগানো দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
Leave a Reply