অনুভব কর্মকার, কুঁদঘাট, ১৪ মার্চ#
টালিগঞ্জ থেকে কুঁদঘাট মেট্রোর যে লাইনটা গেছে, সেই জায়গাটাও কাস্তের মতো বাঁকা। তাই সেখান দিয়ে আসতে কখনো কখনো অস্বস্তি হয়, ভয় লাগে। কোনো একটা সময় যে সেখানকার একটা চাঙর ভেঙে পড়বে সেটা ভাবা যায় না। আমি দেখি, ওই সময় ট্রেন আস্তে করে দেওয়া হয়, হয়তো ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই।
খবরে প্রকাশ, উল্টোডাঙার ভেঙে পড়া উড়ালপুলের চাঙরটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, ডিজাইনটি আরেকটু ভালো হওয়া উচিত ছিল, একটা অতিরিক্ত ক্যান্টিলিভার দেওয়া গেলে ভালো হত …। কিন্তু বিষয়টি মূলত অর্থনৈতিক।
আগেকার দিনে যখন ডিজাইন করা হত, তখন বলা হত ‘ফ্যাক্টর অফ ইগনোরেন্স’, যেটাকে পরে বলা হয়, ফ্যাক্টর অফ সেফটি বা নিরাপত্তার কারণে কিছুটা বাড়তি গঠন করা। মানে দাঁড়ায়, যদি ওই উড়ালপুলটি ২০ টন ভার বহন করতে সক্ষম বলে বলা হয়, আসলে সেটি ২০-র কিছু বেশি পরিমাণ ভার বহনে সক্ষম হিসেবে ডিজাইন করা হয়। তাতে কাঁচামাল বেশি খরচ হয়, গঠনের জন্য আনুষঙ্গিক খরচও কিছুটা বেশি ধরতে হয়। এখন কোম্পানি ডিজাইনারকে বলে দেয়, যথাসম্ভব কম ফ্যাক্টর অফ সেফটি রাখতে, যাতে কোম্পানির লাভটা বেশি হয়।
তাছাড়া একজন ডিজাইনারের কাজ তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন তার ডিজাইনটি মেনে কাজটা সম্পূর্ণ হয় এবং জিনিসটির কমিশনিং হয়। বাস্তবে দেখা যায়, একজন ডিজাইনার যেরকম ভাবছে বা বলে দিচ্ছে, কার্যক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। ফারাক হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেখা যায়, অনেক কোম্পানিরই ডিজাইনের ডিপার্টমেন্টটি হল নিজস্ব ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু নির্মাণকার্যে তাদের নিজস্ব কোনো লোক থাকে না। সস্তায় যাতে কাজটা হয়, তার জন্য নির্মাণের ভার দেওয়া হয় কোনো কন্ট্রাক্টরকে, তারপর আবার তা কোনো সাব কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে দেয় কন্ট্রাক্টর। সেই সাব কন্ট্রাক্টর ফের সাব কন্ট্রাক্টে দিতে পারে। এগুলি সবই করা হয় প্রতিটি স্তরে সর্বোচ্চ লাভ কামানোর জন্য। কিন্তু এটা করতে গিয়ে প্রচুর অদক্ষ শ্রমিকরা নির্মাণকার্যে ঢুকে পড়ে এবং নির্মাণে যে গুণমান বজায় রাখা দরকার, তা অনেকসময়ই বজায় থাকে না।
আগে যখন এসব করা হত, তখন গুণমান বজায় রেখে ধীরে ধীরে কাজটা করা হত। কিন্তু এখন খুব কম সময়ের মধ্যে কাজটি করে ফেলার পরিকল্পনা থাকে। এটা করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গুণমানের দিক বজায় রাখা যায় না।
আরেকটা ব্যাপারও আছে। অনেক সময় দেখা যায়, ডিজাইনাররা খাতা-কলমে যে নিরাপদ ডিজাইনটি করে, তা বাস্তবে নিরাপদ না-ও হতে পারে। তাই ডিজাইনও সেরকম হওয়া দরকার, যা বাস্তবধর্মী হয়।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সবটা করা সম্ভব হয় না। নকশা ও নির্মাণে অভিজ্ঞ পেশাদারদের দিয়ে এই কাজ করানো দরকার। নির্মাণের সময় নির্মাণ কাজে যুক্ত শ্রমিক থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার, তাদের কাছ থেকে ডিজাইনের প্রতি মুহূর্তে মতামত নেওয়া ও সেই অনুযায়ী নকশায় দরকার মতো পরিবর্তন করা জরুরি।
একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে কত কম খরচে করা সম্ভব তা ভাবা হয়, তখন দক্ষ কি অদক্ষ, কী ধরনের শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে তা নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না, এতে ভুলের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আর একটা উড়ালপুল তৈরি হয়ে গেলে, তার রক্ষণাবেক্ষণের নিরন্তর একটি বন্দোবস্ত থাকা দরকার। এখানে এই রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
Leave a Reply