মিত্রা চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, ১১ সেপ্টেম্বর#
কলকাতার অন্যতম সুপরিকল্পিত উপনগরী সল্টলেক। স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বাস। সাজানো বাড়ি। পার্ক। তবু ডেঙ্গুর প্রকোপ সেখানেই বেশি। এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এখানকার মানুষ। ২২৫টি ঘরে ডেঙ্গুর লার্ভা।
আগস্টের শুরু থেকেই ঘরে ঘরে জ্বর। রক্তপরীক্ষার (Dengu NS1 Antigen) প্রাথমিক পর্যায়েই ৮০ শতাংশ লোকের দেহে ধরা পড়তে লাগল ডেঙ্গুর উপস্থিতি। প্যাথলজিক্যাল ল্যাবগুলিতে রোগীর ভিড়। শুধু রক্ত দিতেই বসে থাকতে হচ্ছে এক থেকে দেড় ঘন্টা। তারপর সেই রিপোর্ট আনতেও একই অবস্থা। বেশি জ্বরে, ক্লিনিকের কর্মীরা, সকাল থেকে সন্ধ্যে রোগীর বাড়ি বাড়ি রক্ত সংগ্রহের জন্য এল। কিন্তু এ সবই সচেতন মানুষের বেসরকারি উদ্যোগের সাহায্য নেওয়া। সল্টলেক লাগোয়া গরীব ঘন-জনবসতির জন্য কিছু নেই। সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরের কোনও সাড়া ছিল না।
ডাক্তারের পরামর্শে অনেকেই শরণাপন্ন হল কাছাকাছি বেসরকারি হাসপাতালে। প্রথম দিকে রোগীর ভর্তি ও চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত থাকলেও পরে রোগীর সংখ্যা বাড়লে তাদের ফিরিয়ে দিল হাসপাতালগুলি। জায়গা নেই বলে। ক্রমশ রক্ত দুষ্প্রাপ্য হতে লাগল যা অনিবার্য, কারণ, ডেঙ্গু রোগীর রক্তে প্লেটলেট কাউন্ট বা অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে গেলে রক্ত লাগে।
বিধাননগরে জনবাসীর চোখে আতঙ্ক। দৈনিক পত্রিকাগুলিতে তার প্রতিফলন। এবার পৌরসভার সাড়া পড়ল। ক্রমাগত ডেঙ্গুর প্রকোপের তথ্য অস্বীকার করে যাবার পর কিছুটা সচেষ্ট হতে দেখা গেল পৌরসভাকে। সচেতনতা বাড়াতে বাড়িতে বাড়িতে র্যাপিড ফোর্স পাঠান, মশা মারার তেল, ধোঁয়া, এবং ব্লিচিং পাউডার ছড়ানোর ব্যবস্থা শুরু হল।
এসডিও মলয় মুখোপাধ্যায় জানান, র্যাপিড ফোর্স সার্ভে করে ২২৫টি বাড়িতে ডেঙ্গুর লার্ভা খুঁজে বের করেছে। আগেই নির্ধারণ করা হয়েছিল, ডেঙ্গুর লার্ভা যেসব বাড়িতে পাওয়া যাবে, তাদের বাড়ি পরিষ্কার করার নোটিশ দেওয়া হবে। সেই অনুসারেই উপরোক্ত বাড়িগুলিতে নোটিশ দেওয়া হয়। এদের নোটিশ দেওয়ার পরও যদি লার্ভা পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে হাজার টাকা ফাইন করা হবে বলে জানান এসডিও। তারপরেও যদি কোনও বাড়ি সচেতন না হয়, তবে তাদের দিন প্রতি আরো ৫০ টাকা করে ফাইন করা হবে।
সার্ভে করে দেখা গেছে, সিপিডব্লুডি কোয়ার্টারে ৪০০-র বেশি কন্টেনারে মশার লার্ভা, এফডি (সেখানেই পৌরসভার অফিস), ইডি ব্লকগুলিতে একশ’রও বেশি কন্টেনারে মশার লার্ভা এবং পঞ্চাশের বেশি কন্টেনারে লার্ভা পাওয়া গেছে এএল, জিডি, ইসি, সিকে, এফই, সিজি, বিজি, বিএফ ব্লকগুলিতে। মশার এই প্রকোপে জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে বলেছেন পৌরপ্রধান।
কিন্তু সল্টলেকের পরিত্যক্ত জমির জঞ্জালের স্তুপে ও জমা জলে মশার সুখের সংসার। বিধাননগরে বাড়ি বাড়ি র্যাপিড ফোর্স পাঠিয়ে মশার লার্ভা খোঁজা হচ্ছে। অপরদিকে সকলের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে ভ্যাকেট প্লট। এখনও সল্টলেকে অনেক প্লট রয়েছে যা পরিত্যক্ত। কোথাও অর্ধেক কনস্ট্রাকশনের কাজ হয়ে পড়ে আছে, কোথাও আগাছার জঙ্গল বর্ষায় আরও ঘনিয়ে উঠেছে। সল্টলেক আধুনিক হয়ে উঠলেও জঞ্জাল ফেলা নিয়ে এখনও সচেতন হয়ে উঠতে পারেনি। তাই পরিত্যক্ত জমিগুলিতে জঞ্জাল ফেলে সেখানে এক অঘোষিত ডাস্টবিন গড়ে ওঠে। বেশিরভাগ ভ্যাকেট প্লট তাই জঞ্জালের স্তুপের ক্ষত নিয়ে দিন কাটায়। জঞ্জালে ডাবের খোলার রাজত্ব। এদিকে পৌরপ্রচারে ডাবের খোলার জমা জলে মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু যে হাল সেই হালই রয়ে যাচ্ছে। মশার উৎপাত যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা এবারের ডেঙ্গু প্রকোপ প্রমাণ করল।
এডিস মশা যেভাবে এই বর্ষায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল তাতে জঞ্জাল ফেলা নিয়েও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
Leave a Reply