অলোক দত্ত, কলকাতা, ২৯ মে#
গত ১৮ এপ্রিল শুক্রবার দক্ষ সমাজকর্মী জয়দেব একটি উদ্ধার করা কেউটে সাপকে নিয়ে সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট সজনেখালি রেঞ্জ-এ মুক্ত করতে গিয়েছিলেন। সেখানেই ওই সাপটির কামড় খেয়েছেন। তারপর নিজেই নির্ভীকভাবে গোসাবা হাসপাতালে পৌঁছেছেন দেড় ঘন্টার মধ্যে। তৎসত্ত্বেও তিনি মারা গেলেন সেই হাসপাতালে পৌঁছানোর চল্লিশ মিনিটের মধ্যে।
জয়দেব মণ্ডল : বয়স সাঁইত্রিশ বছর। পেশা : মধু সংগ্রহ। সাড়ে পাঁচ বছরের একটি পুত্র সন্তান ও আড়াই বছর বয়সি এক কন্যা সন্তানের জনক। পিতা মাতা স্ত্রী বর্তমান। ‘সাপের কামড়ে আর মৃত্যুমুখে নয়’ — এই আন্দোলনের পুরোধা। ‘যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা : ক্যানিং’-এর অভিজ্ঞ সদস্য।
সাপের কামড় খাওয়া মানুষকে বাঁচাতেন, মারকুটে মানুষের হাত থেকে সাপকে উদ্ধার করে আনতেন, মরা সাপকে কবর দিয়ে ফুল ছড়িয়ে দিতেন তার ওপর।
সেদিন কী হয়েছিল হাসপাতালে
যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা, ক্যানিং-এর বিজন ভট্টাচার্যের বিবরণমতো — সর্পদংশনে ধ্বস্ত জয়দেব যখন হাসপাতালে পৌঁছালেন তখন বিষের ক্রিয়ায় গলায় লালা জমে গিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ। কথা বলবেন সে ক্ষমতা ছিল না তাঁর। চিকিৎসক-নার্স কেউই যখন আসছেন না, এমতাবস্থায় জয়দেব অতি প্রয়োজনীয় স্থিরবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে দুটি কাগজে দুটি আলাদা আলাদা কথা লিখে তাঁর সঙ্গীকে দিয়ে ডাক্তার ও নার্সের উদ্দেশ্যে পাঠালেন। ডাক্তারের উদ্দেশ্যে লিখলেন, ‘এভিএস’ অর্থাৎ অ্যান্টি ভেনম সেরাম। আর নার্সদের উদ্দেশ্যে লিখলেন, ‘গলায় লালা’। তারপরই জ্ঞান হারালেন তিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই লেখাদুটিকে কোনো গুরুত্বই দিলেন না। ফলত, এর চল্লিশ মিনিট পরে গলায় লালা জমে শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেলেন জয়দেব!
গোসাবা হাসপাতালের হেল্পলাইন মারফত ‘যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা, ক্যানিং’ এই ঘটনাটা জেনেছে আধঘন্টা দেরিতে। তখনই সংস্থা গোসাবা হাসপাতালে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু চিকিৎসকদের উদাসীন, গা-ছাড়া ও অনিচ্ছুক ব্যবহার পেয়ে বিস্মিত হতবাক হয়ে পড়েছিল। কথা চলার মাঝখানে একাধিকবার লাইন কেটে দিয়ে দায় সেরেছেন হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা। তারপর আবারও হেল্পলাইনে যোগাযোগ করে সংস্থা জানতে পারে রুগি মারা গেছেন।
জয়দেব মারা যাওয়ার পরে প্রতিবাদ হয়েছে, হচ্ছে, হয়ে চলেছে ক্রমাগত। চব্বিশে এপ্রিল ক্যানিং স্টেশনে প্রতিবাদ সভা হয়েছে। ২৬ এপ্রিল হয়েছে গদখালিতে, জয়দেবের নিজের বাড়ির কাছাকাছি। সাত আটশো মানুষ জমা হয়েছিলেন সেখানে। আরেকটা সভা হয়েছে ৬ মে ক্যানিং স্টেশন সংলগ্ন স্থানে। ২৬ মে গোসাবা হাসপাতালেও বিক্ষোভ হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। তখনই একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। সাপের কামড়ে তদন্ত কমিটি সম্ভবত এই প্রথম।
কেমন মানুষ ছিলেন জয়দেব
যার মৃত্যুতে মসজিদবাটী ও গদখালি — বাসন্তী ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ হাহাকার করছে, — এবার থেকে আমাদের বাঁচাবে কে? … রাতে মশারির ওপরে সাপ! — তো ডাক জয়দেবকে, … বিছানায় কালাচ সাপ! — তো ডাক জয়দেবকে।
কুশলী হাতে গত চার বছরে তিনি কেউটে ধরেছেন আঠাশটি, কালাচ বারোটি, চন্দ্রবোড়া দুটি, শাঁখামুটি একটি, শঙ্খচূড় একটি। এই সমস্ত সাপ উদ্ধার করে তিনি সেগুলোকে নতুন জীবন দান করেছেন, কখনও সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট-এর হাতে তুলে দিয়ে, কখনও ব্যক্তিগতভাবে, কখনও বা সংস্থার মাধ্যমে।
বাসন্তী ব্লকের মসজিদবাটী এলাকাটি খুবই সর্পাঘাতপ্রবণ। প্রায়ই মান্দাস আসতে দেখা যেত ওই অঞ্চলে। জয়দেবের হাত ধরেই অঞ্চলের মানুষ সাপের কামড় খেলে ওঝা গুণিন ছেড়ে এখন হাসপাতালে পৌঁছাতে শিখেছে।
ত্রিশজনের বেশি সাপে কাটা রুগিকে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কিংবা মৃত্যুভয় থেকে বাঁচিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, বারংবার প্রাণপাত পরিশ্রম করে দুর্গম এলাকা থেকে রুগিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে, অভিজ্ঞ মানবিকতাসম্পন্ন ডাক্তারদের সহযোগিতা নিয়ে, সর্বক্ষণ সঙ্গে থেকে। দিন রাত এক করে জীবনদায়ী ওষুধ বা রক্ত জোগাড় করে আনতে ছুটোছুটি কম করেননি তিনি।
মানুষকে ভালোবেসেছিলেন জয়দেব। সাপের বিষের হাত থেকে মানুষকে বাঁচিয়েছেন পরম মমতায়। সাপকেও বাঁচিয়েছেন মারকুটে মানুষের হাত থেকে। সাপ মরলে মাটি খুঁড়ে সেটাকে কবর দিয়ে তার ওপরে ফুল ছড়িয়ে দিতেন তিনি।
যে কোনো বিপজ্জনক কাজে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে, সাপ ধরার ক্ষেত্রেও আছে। জয়দেবের ক্ষেত্রেও হয়েছে দুর্ঘটনা। দু-দুবার সাপের কামড় খেয়ে হাসপাতালে গিয়ে বেঁচেছেন তিনি। ২০১২ সালে সোনারপুরে গিয়ে চন্দ্রবোড়ার কামড় খেয়ে কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে ছিলেন, আরেকবার ২০১৩ সালে বাসন্তীতে কেউটের কামড় খেয়ে বাসন্তী হাসপাতালে।
Tapas Bhattacharyya says
Khobor-ta shune obdhi mon-ta boro-i kharap hoye galo….Joydeb-ke aami chintaam…. Kichhu bolar nei….shudhu ekta okkhom raag bhetore bhetore maatha khNure morchhe…..Ei ki hobar chhilo???