সংবাদসংলাপ#
১৬ আগস্ট সংখ্যায় শোভা ধানির প্রতিবেদন ‘কীভাবে তৈরি হল সরবেরিয়ার সুন্দরবন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প’ প্রসঙ্গে এই পত্র। বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প এবং সুন্দরবন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে কতকগুলো তথ্য পরিবেশনের দায় অনুভব করছি।
সরবেরিয়া কৃষিচক্র তার চলা শুরু করে ১৯৮৯ সালে। কৃষি, মৎস্যচাষ, পশুপালন করত তারা। অরুণ সেন, শামলা হালকা পাতলা একটি মানুষ, এই সবের মূল হোতা। আজও, সমান একাগ্রতায়, নিষ্ঠায়। ১৯৯২ তে নতুন পদক্ষেপ মশলা তৈরি। ১৯৯৯ সালে বেলুড় শ্রমজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ কিরীটি রায়ের সহযোগিতায়। ওই বছরই জুন মাস থেকে ১৪ দিন পর পর স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন। এর আগেও তারা স্বাস্থ্য শিবিরের নিয়মিত আয়োজনের প্রচেষ্টা করেছিল ‘খড়দা বিজ্ঞান পরিষদ’-এর সহযোগিতায়, মাসে একবার বসত সেই শিবির। সেটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী প্রথম সুযোগেই তারা আবার বেলুড় শ্রমজীবীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষিজীবী উদ্যোগে একটি হাসপাতাল স্থাপন করা। কেন তারা এইরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল শোভা ধানি সে কথাটা বড়ো সুন্দর করে বলেছেন। আবার তার উল্লেখের প্রয়োজন দেখি না। ২০০২ সালে ণ্ণসুন্দরবন হাসপাতাল’ চালু হল পরীক্ষামূলকভাবে। নিজেদেরকে নিজেরা চিনে নেওয়ার এই প্রক্রিয়াটি প্রাপ্ত মানুষদের মজ্জাগত। নিজস্ব প্রান্তিক অবস্থানের অভিজ্ঞতায় এইটুকু অনুভব করতে পারি।
অবশেষে, ২০০২ সালেরই ২৯ ডিসেম্বর ‘সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল (স্বাস্থ্যপ্রকল্প)’-এর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়ে যায়। তখন অবশ্য আমাদের প্রিয় মাসীমা রেবা সেন, অরুণ সেনের জননী আর আমাদের মধ্যে নেই। তিনি জেনে গেছেন, তাঁর সাধের হাসপাতাল-এর কথা, শুধু এটুকুই আমাদের সান্তনা হয়ে রইল। হাসপাতালের জমিটিও তাঁরই দান করা। রেবা সেন-কে আমরা মাসীমা বলেই ডাকতাম, কিন্তু মমতা দিয়েছেন মায়ের মতোই অকাতরে। তাঁর উল্লেখকালে, ‘এলাকার একজন বৃদ্ধা’ শব্দবন্ধ কেমন যেন বেমানান লেগেছে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত কারণই এর জন্য দায়ী, লেখকের এতে কোনো দায় নেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার, কৃষিচক্র কিন্তু কৃষি উৎপাদন থেকে সরে আসেনি। এখনও, হাসপাতালের হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও ওখানে যে শাকসবজি ফলানো হয়, তাতে করে দৈনন্দিনের যৌথ রান্নাঘরটি বেশ চলে যায়। কৃষিচক্রের মশলা এখন বেশ সুনামের সঙ্গে অনেকের প্রয়োজন মিটিয়ে চলেছে। সঙ্গে ওরা বানাচ্ছে আচার, ঘি, বড়ি ইত্যাদি।
এই অবসরে আর একটি নিবেদন আছে আমার। ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা পরিচালিত শহিদ হাসপাতাল এবং ইন্দোজাপান স্টীলস লি. এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন পরিচালিত বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতি — দুটোরই পথ চলা শুরু আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৩ সালে। ছত্তিশগড়ে শঙ্কর গুহনিয়োগী যখন তাঁর মুক্তিমোর্চার সাথীদের সঙ্গে নিয়ে শ্রমিকস্বার্থে কাজ করছেন, একই সময়ে বেলুড়ে ফনীগোপাল ভট্টাচার্য এবং তাঁর শ্রমিক বন্ধুরা একই কাজ করছিলেন। পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল না। সেতুবন্ধনের কাজটি করেছিলেন শ্রী প্রফুল্ল চক্রবর্তী। ১৯৭৯-র শেষের দিকে। তারপর নিয়োগী এবং ভট্টাচার্য, কে কার কাছে অনুপ্রেরণা পেলেন অথবা পেলেন না, তাতে আর কিছু যায় আসেনি। রচিত হয়েছে ইতিহাস। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহিদ হাসপাতাল, শ্রমজীবী হাসপাতাল।
কথাগুলি লিখছি এই কারণে যে, আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে কেউ এই শ্রমিক কৃষক উদ্যোগের বিষয়টি সমাজবীক্ষণের আওতায় আনতে সচেষ্ট হবেন। সেদিন তাঁর হাতে যেন ঠিকঠাক তথ্যগুলি পৌঁছোয়। তিনি যেন এইসব মানুষগুলোর জন্য গর্ববোধ করতে পারেন যে এরা তাঁরই দেশের মানুষ। খেটে খাওয়া মানুষ। জীবনের সুন্দর সময়গুলিকে একসূত্রে গেঁথে তারা রেখে গেছে উত্তরসূরীদের জন্য। ভবিষ্যৎ যেন তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে, রসদের যোগান পায়। রক্ষা করতে পারে।
ধন্যবাদ শোভা ধানি, খবরের কাগজ সংবাদমন্থন, আমাকে এই কথাগুলো বলবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
বনানী ভট্টাচার্য্য,
বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতি।
Leave a Reply