সরকার থেকে এখানে প্রথমে মাইক এনে হেঁকেছিল, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে উঠে যেতে হবে, নাহলে ঘরদোর ভেঙে দেওয়া হবে। তখন লোকে ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের টিএমসির যে সভাপতি, তাঁর কাছে গিয়েছিল। তিনি এসব শুনে বললেন, এটা তো ঠিক নয়, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মানুষ কোথায় যাবে। আপনারা এক কাজ করুন, আমাদের মাননীয় বিধায়ক জাভেদ খানের কাছে চলে যান। এরা তখন সকলে গেল তাঁর কাছে, দেখা পেল না। তাঁর ছেলে বলল, বাবা বেরিয়ে গেছে, আগামী কাল আসুন। পরের দিনও গেল, উনি বললেন, ঠিক আছে, দেখছি। অপেক্ষা করুন।
দু-দিন পরেই এখানে আবার মাইকে হাঁকছে কেএমডি থেকে, বারো ঘন্টা সময় দিচ্ছি, ভেঙে দেব তা না হলে। আপনারা উঠে যান। তখন লোকে গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে। তাঁর বাড়ির সামনে থেকে পুলিশের লোকজন থামিয়ে বলল, এই দপ্তরটা তো নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর। তাঁকে খবর দিচ্ছি, তিনি আসবেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। বলে, লোকজনকে নিয়ে এল কালীঘাট থানায়। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম কালীঘাট থানায় এসে এদের সমস্ত কথাবার্তা শুনে বললেন, না-না-না-না, আমরা তো উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। আপনারা এক কাজ করুন, আপনাদের পরিচয়পত্র নিয়ে সল্টলেকের উন্নয়ন ভবনে আমার দপ্তরে আসুন দু-দিন পর। অনেকে বলল, আমার তো শহরে কোনো পরিচয়পত্র নেই, গ্রামের মানুষ, গ্রামের পরিচয়পত্র আছে। মন্ত্রী বলল, ঠিক আছে, আপনারা যে এদেশের বাসিন্দা, তার প্রমাণপত্রটা দরকার।
তার দু-দিন পরে যারা পরিচয়পত্র জোগাড় করতে পারল, মন্ত্রীর দফতরে গেল পরিচয়পত্র নিয়ে, তিনি বললেন, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, কিছু হবে না। ঠিক তার পরের দিন এসে বুলডোজার দিয়ে এগুলো ভেঙে দিল। অর্থাৎ মন্ত্রী মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এভাবে গরিব মানুষের সঙ্গে কেউ মিথ্যে কথা বলে? একজন মাননীয় মন্ত্রী হয়ে? তাই দাবি একটাই, কোথায় যাব, আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই, চাই চাই।
সরকার পরিচয়পত্র দেখতে চাইছে। এই নোনাডাঙায় যাদের পুনর্বাসন হয়েছে এখনও অবধি, তাদের অনেকেরই কোনো পরিচয়পত্র ছিল না, রেশন কার্ড ছিল না। তাহলে তাদের পুনর্বাসন হল কী করে? গ্রাম থেকে যে মানুষজন এসেছে, তাদের পরিচয়পত্র তো গ্রামে পড়ে রয়েছে। শহরে এমন মানুষও আছে, তিরিশ বছর ধরে বসবাস করে, যার কোনও পরিচয়পত্র নেই। পরিচয়পত্র দেখালে পুনর্বাসন হবে, কী অদ্ভুত কথা। সে কি ভারতের নাগরিক নয় নাকি?
আর তার পরিচয়পত্র করে দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারের! যদি কারো পরিচয়পত্র না থাকে, তাহলে সরকার পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য পরিচয়পত্র করে দেবে। এটাই তো মূল কথা। তার পরিচয়পত্র নেই, তার জন্য সে দায়ী না সরকার দায়ী? কেন করে দেয়নি এত বছর? সে এদেশের নাগরিক। সে জার্মান থেকে আসেনি, জাপান থেকে আসেনি, বাংলাদেশ থেকে আসেনি, পাকিস্তান থেকে আসেনি। এসেছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য গ্রাম থেকে। সরকার তাদের পরিচয়পত্র করে দিয়ে পুনর্বাসন দেবে। গ্রামের থেকে এখানে এসেছে, অভাবের জ্বালায়, বাঁচার তাগিদে। তাকে জায়গা করে দেবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
মন্ত্রী বলছেন, যারা আয়লার ফলে এখানে এসেছে, তাদের জন্য আলাদা ঘরের স্কিম আছে। সেই স্কিমে ঘর নিয়ে গ্রামে ফিরে যাক। সে তো খাতায় কলমে। ক’টা লোক পাচ্ছে? যার ঘরবাড়ি রয়েছে, জমি রয়েছে, সে টাকা পাচ্ছে। এই সব স্কিমের ছেঁদোমার্কা গল্প করে তো লাভ হবে না। গ্রামে হয়ত সবাই আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখানে আসেনি। কিন্তু গ্রামে তো কাজ নেই। শুধু ঘরটা থাকলে তো পেট ভরবে না। ঘরের সাথে সাথে কাজ দরকার, পয়সা দরকার, দুটো ভাত দরকার। সরকার বলুক, যার যে গ্রামে বাড়ি আছে, চলুন, আমরা কাজের ব্যবস্থা করে দেব, খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। গ্রামে থাকুন। সবাই এক্ষুনি চলে যাবে।
Leave a Reply