দার্জিলিং ক্রনিকলে প্রকাশিত হেমন্ত সুব্বার খোলা চিঠির নেপালী থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন শমীক চক্রবর্তী, ১৫ সেপ্টেম্বর#
যক্ষ্মারোগ নিরাময়ের জন্য সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে কার্শিয়াংয়ের বুকে অবস্থিত এস. বি. দে স্যানিটোরিয়াম শুধু পাহাড়ের নয়, সম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গেরই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। গৌরবময় ইতিহাসের অধিকারী এই প্রতিষ্ঠানে যক্ষ্মা সম্বন্ধীয় সমস্ত রকমের চিকিত্সা বা পরীক্ষানিরীক্ষা হত। সুন্দর ও অনুকূল প্রাকৃতিক বাতাবরণ হওয়ায় এখানে উত্তরবঙ্গের যক্ষ্মারোগীরা শুধু নয়, সারা ভারত থেকে, এমনকি প্রতিবেশী দেশ থেকেও রোগীরা এখানে যক্ষ্মারোগ নিরাময়ের জন্য আসতেন। এখনও যক্ষ্মা রোগ সম্বন্ধীয় সমস্ত চিকিত্সার জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি (যেগুলো জাপানের মত দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল) হাসপাতাল পরিসরের ভিতরেই আছে, কিন্তু সেসব ব্যবহার করা হয় না। এই কথাগুলো এস. বি. দে স্যানিটোরিয়ামে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত কর্মচারীদের থেকে শোনা। আজ যক্ষ্মারোগীদের সাধারণ এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষার মত প্রাথমিক ব্যবস্থার জন্যও মহকুমা হাসপাতাল পর্যন্ত দৌড়তে হয়। এমনকি শ্বাসকষ্ট বাড়লে বা ওষুধের কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া (বমি বমি ভাব, পা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি) দেখা গেলেই এখানকার চিকিত্সকরা মহকুমা হাসপাতাল হয়ে সোজা উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেন।
আগে ডাক্তার ব্যানার্জী, ডাক্তার গুহ-র মত মহান চিকিত্সকের সময়ে এই হাসপাতালেই অনেক ‘মেজর অপারেশন’ যথাযথভাবে হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে। অর্থাৎ এরকম গৌরবময় ইতিহাস বহন করে আসা এস. বি. দে স্যানিটোরিয়াম আজ এক মৃত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভুমিকা পালন করছে আর ডাক্তাররা নিছক কম্পাউন্ডারের ভুমিকা পালন করছেন বলে মনে হচ্ছে।
এস. বি. দে স্যানিটোরিয়ামকে ঐতিহাসিক ভবন হিসেবে বাঁচিয়ে রাখাটা যক্ষারোগীদের দাবি নয়। একে পুনরুজ্জীবিত করা এই কারণে জরুরি যে উত্তরবঙ্গ থেকে যক্ষ্মারোগ নির্মূল হওয়ার বদলে আরও ছড়িয়ে পড়ছে। যক্ষ্মারোগের নিরাময় সম্ভব হওয়ার পর থেকে সরকার এই রোগকে সাধারণ রোগ (common disease) অর্থাৎ সহজেই নিরাময় করা যায় এমন রোগ হিসেবে একে গণ্য করে আসছে। আমাদের এটা মানতে হবে যে আজ যক্ষ্মারোগ সাধারণ রোগ হয়েছে কেননা এর ওষুধ পাড়াগাঁয়ের কাছাকাছি গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রতেই পাওয়া সম্ভব। তবে পাড়াগাঁয়ের কাছাকাছি এর ওষুধ পাওয়া গেলেই এই রোগ আমাদের সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে যাবে বলে সরকারের ধারণাটা একেবারেই ভ্রান্ত। ‘ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ হলেই রোগ সেরে যাবে’— এই ভ্রান্ত ধারণার কারণেই আমাদের সমাজে এই রোগ একটা সাধারণ রোগ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই ভ্রান্ত ধারণার কারণেই অধিকাংশ যক্ষ্মারোগীরা শুরুতে অসুস্থ হওয়ার সময় ক্যাটেগরি-১ এর ছয় মাসের ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ করা সত্ত্বেও সেরে ওঠেন না। এই ভ্রান্ত ধারণার কারণেই ক্যাটেগরি-১ ব্যর্থ হলে ক্যাটেগরি-২ এর নয় মাসের কোর্স আর ক্যাটেগরি-৪ (MDR) এর ২৪-২৫ মাসের কোর্স সম্পূর্ণ করেও নিরাময় না হয়ে উল্টে প্রাণ হারানোর মত তিক্ত বাস্তব আমাদের চোখ এড়ায়নি।
এখন প্রশ্ন হল এমনটা কেন হচ্ছে? চিকিত্সার জন্য ওষুধ সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও কেন ক্ষয়রোগ নির্মূল হয়নি আজও? কেন যক্ষ্মা রোগের জন্য আজও মানুষকে মৃত্যুমুখে পড়তে হচ্ছে? এর একটাই উত্তর যে পাড়াগাঁয়ে মানুষের মধ্যে যক্ষ্মারোগ নিয়ে সচেতনতা নেই। এই সচেতনতার এভাবেই যক্ষ্মারোগীদের সংখ্যা কমার বদলে বেড়ে গেছে ক্রমশঃ।
এস. বি. দে স্যানেটোরিয়ামে আমি, হেমন্ত সুব্বা, বিগত সাত মাস ধরে চিকিত্সাধীন। এই সাত মাসে আমি চিকিত্সাধীন ৭ জনের মৃত্যু হতে দেখেছি। এই সাত মাসে যক্ষ্মা রোগ নিয়ে একবারও কাউন্সেলিং হয়নি। অবস্থা এমন করুণ যে রোগীরা হাসপাতাল থেকে দেওয়া খাবার না খেতে পেরে ১ কিমি দূরে কার্শিয়াং বাজারের হোটেলগুলোতে খাবার খেতে যায়, যা হাসপাতালের নিয়মবিধি বহির্ভূত ব্যাপার। কিন্তু উপায়ান্তর না পেয়ে রোগীরা বাধ্য হন এসব করতে।
একজন রোগীর বক্তব্য— “আমাদের এটা ভাবা দরকার যে উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ যক্ষ্মারোগ নিরাময় প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই যদি আজ এরকম হয়, তাহলে এই রোগ নিয়ে আপনার -আমার পাড়াগাঁয়ে কী অবস্থা বলুন তো?”
যদি সরকার সত্যিই যক্ষ্মারোগ নির্মূল করতে চায় তাহলে ওষুধের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে যক্ষ্মারোগ নিয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া জরুরি। এটা না করলে এই সংখ্যা ৬ থেকে ১২ হয়ে যে ২৪ হবে না — সেটা বলা যায় না। এই কারণে আমরা বলতে পারি যে ‘আমাদের দেশ থেকে যক্ষ্মারোগ নির্মূল হয়ে গেছে/যাচ্ছে’ বলে সরকারের দাবি ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এই কারণেই সমস্ত উত্তরবঙ্গ থেকে যক্ষ্মারোগ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এস. বি. দে স্যানেটোরিয়াম বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
এস. বি. দে স্যানেটোরিয়ামের যক্ষ্মারোগীরা এই কথাগুলোকে নিজেদের ভোগান্তি দিয়ে অনুধাবন করেছেন, বুঝেছেন যে এই হাসপাতালকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আর তাই গত মে মাস থেকে নিজেদেরই সামর্থ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে আসছেন। হাসপাতালে চিকিত্সাধীন যক্ষ্মারোগীদের যে সমস্যাগুলোয় পড়তে হয়, সেগুলো নিয়ে কখনও লিখিতভাবে কখনও বা মৌখিকভাবে হাসপাতালের ‘সুপারিন্টেন্ডেন্ট’ বা কার্শিয়াং মহকুমার এসডিওকে লিখিতভাবে দাবি পেশ করে এসেছেন। এরকম দাবিপত্র অনেকবার জমা দেওয়ার পরেও কিছুমাত্র ফলাফল না হওয়ায় শেষমেষ ২২ জুলাই ২০১৫ এস. বি. দে স্যানেটোরিয়ামের যক্ষ্মারোগীরা এক হয়ে হাতে ব্যানার নিয়ে কার্শিয়াং বাজারে মিছিল করে বিক্ষোভ দেখান। এর কয়েকদিন পরে ২৫ জুলাই ২০১৫ এস. বি. দে স্যানেটোরিয়ামে CMOH (Chief Medical Officer of Health) আসেন। স্যানেটোরিয়ামের যক্ষ্মারোগীরা তাদের খাবারদাবার, হাসপাতাল সাফাইয়ের হালত, বিদ্যুৎ পরিসেবা, হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টের সমস্যাগুলো নিয়ে তথ্যসহকারে তাঁর কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। উনি এক মাসের ভেতরে সমস্ত দাবিপূরণের আশ্বাস দেন। ওনার আশ্বাস অনুযায়ী এক-দুটো ব্যাপারে আংশিক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও মোটের ওপরে ব্যাপারটা যা ছিল, তাই-ই আছে বলে রোগীরা বলছেন।
যক্ষ্মারোগীদের দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়। তাই যক্ষ্মারোগীদের নিজেদের এই সময়কে কার্যকরী ভাবে কাটাতে এখানে সেরকম কোনও ব্যবস্থাই নেই। রোগীদের রোগী হিসেবেই থাকতে হবে, তাদের মানসিকভাবে ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে, এবং এই পরিস্থিতি থেকে তাঁদের বের করে আনার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে। রোগীদের মনোরঞ্জনের দরকার, কিন্তু হাসপাতালে এরকম কোনও ব্যবস্থা কোনও কালেই নেই বলে জানাচ্ছেন চিকিত্সাধীন রোগীরা। তাই যক্ষ্মারোগীরা মানসিক অবসাদেরও শিকার হচ্ছেন। গত চার মাসে তিন জন চিকিত্সাধীন রোগী মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন বলে জানাচ্ছিলেন এক যক্ষ্মারোগী বিশাল থাপা।
এখানে কর্মরত নার্সদের থেকে শোনা গেল যে এখানে যক্ষ্মারোগীদের জন্য দীর্ঘ দিন কাউন্সেলিং-এর কোনও ব্যবস্থাই হয়নি। কাউন্সেলিং নিয়ে রোগীরা হাসপাতাল প্রধানের বিরুদ্ধে একটু-আধটু মুখ খুলতেই সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকরা “কেমন আছো তোমরা? একটু ঠিক আছো? ডিসচার্জ কাগজ বানিয়ে দিচ্ছি, বাড়ি যেতে পারো” বলে বলতে শুরু করে… যাদের ইনজেকশন পিরিয়ডও শেষ হয়নি, তাদেরও এভাবে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয় বলে চিকিত্সাধীন রোগীরা বলছিলেন। তাঁরা মনে করেন, এগুলো রোগীরা যাতে আন্দোলিত না হতে পারে তার জন্য আগাম ব্যবস্থা।
যক্ষ্মারোগ সাধারণ একটা রোগ নয়, যে রোগ সারা অতীতে সারা ইউরোপ বা বলা যায় সারা বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। এই রোগ ভয়ানক এবং মানুষকে এর জন্য সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু রোগটা ভয়ানক, রোগীরা নন। এই রোগের কারণটা হল এই ব্যবস্থা যেখানে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ করা হয়। এর শিকার বিশেষ করে গরিব মানুষরাই হন, আর আমাদের পাহাড়ের কথা বলতে গেলে চা-বাগান বা গ্রামগুলোতেই এর সম্ভাবনা বেশি। এই রোগের কারণ কোনও ব্যাকটেরিয়া নয়, বরং আমাদের গোটা রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের কাঠামোটা এর জন্য বেশি করে দায়ী।
যদি রোগীরা ভালোবাসা, ভরসা এবং সাহচর্য পায় তাহলে আমাদের পাহাড় থেকে এই রোগকে নির্মূল করে দেওয়া যাবে, কিন্তু বাস্তবটা তার থেকে একদমই আলাদা। স্যানেটোরিয়ামকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তাকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলানোর দায়িত্বটা এখানকার রোগীদের শুধু নয়, এখানকার সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের। ৭০ এর দশকে অনেক লড়াই করে বেসরকারী হাসপাতাল থেকে আমজনতার সম্পত্তিতে রূপান্তরের বিজয়টাকে আমরা নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে এই স্যানেটোরিয়ামের ভগ্নদশা দেখে চুপ করে বসে আছি। বাস্তবত তো প্রশ্নটা এটা উঠছে যে, আমাদের সমাজের ভয় আজ কাকে— যক্ষ্মারোগকে না মৌনতার রোগকে?
Leave a Reply