সরকারের গালভরা প্রতিশ্রুতিতে নয়, হাতিবাগানের হকাররা আবার নতুন করে তাদের ব্যবসার পসার নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে একান্তই নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের পায়ে। চৈত্র সেলের মাস শুরু হবার আগেই পুড়ে যাওয়া হাতিবাগান বাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ছোটো বড়ো মাঝারি ব্যবসায়ী ও ফুটপাতের হকাররা নতুনভাবে নিজেদের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। আগুনের কারণে বাজারের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকের ভিতরের বহুলাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পুরসভার তরফে বিপজ্জনক অংশ ভাঙা ও ধ্বংস্পস্তূপ সরানোর কাজ শেষ হলে হাতিবাগান বাজার ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরতে চাইছে।
তবে উত্তরের বিল্ডিঙের ভিতরের অংশে লাগোয়া দোকানগুলি পুনর্নির্মাণের কাজ এখনও চলছে। মাছ, ফল, সবজি বাজারের পরিকাঠামো নির্মাণের কাজও চলছে। সবজি ও মাছের বাজারের অধিকাংশ ভাগ তৈরি হলেও, উত্তরের ফল-দশকর্মা-মশলার দোকানগুলির কাজ এখনও হয়নি।
এই বাজারের কেউ কেউ আশে পাশে ছড়িয়েছিটিয়ে বসছে এখনও। বাজারের উত্তর দিকে মশলার দোকান চালান সুজিত দে, কথায় কথায় জানালেন তাঁর দোকানের দিকটায় এখনও ছাউনি হয়নি, তাই রোদের জন্য তিনি সবজি বাজারের একটি আলুর দোকানের পাশে বসেছেন। তাঁদের দোকান নতুন করে নিজেদেরকেই করে নিতে হচ্ছে নিজেদের খরচে। সরকার কোনো সাহায্য করেনি। ‘আমরা প্রায় পাঁচ বছর পিছিয়ে গেলাম। প্রত্যেককেই নিজেদের দোকানের জায়গার মাপমতো বর্গ-ফুট অনুযায়ী দাম দিয়ে দোকান বানিয়ে নিতে হচ্ছে। এজন্য বর্গ-ফুট প্রতি ১৬০-১৭০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্তও খরচ হচ্ছে। অনেকে ধার-দেনা করে করছে। কেউ কেউ জমানো পুঁজি থেকে কেউ আবার বাজার থেকে মাসিক ৫-৬% সুদে টাকা নিয়ে দোকান বানাচ্ছে। কেউ কেউ তো আবার সোনার জিনিস বন্ধক রেখে খরচ বহন করছে।’
বাজারের উত্তর দিকে ফলের বাজারের মধ্যে শুকনো খাবারের দোকান মুকুন্দ পালের। তিনি নিজে এই বাজারে আছেন প্রায় সাঁইত্রিশ বছর। বাবা আর জ্যাঠামশায়ের হাত ধরে এই বাজারে আসা। এখন একটা কালো প্লাস্টিকের ত্রিপল মাথার ওপর টাঙিয়ে বসেছেন রোদের তাপ থেকে বাঁচার জন্য। তাঁর দোকানের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন-চার লক্ষ টাকা। ‘পুড়ে যাবার পর ২৭ মার্চ থেকে আবার বসি। তখন অন্য দিকে বসতাম। এখন নিজের জায়গায় বসছি। এখানে এখনও ছাউনি হয়নি, তিন-চার দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। আমাদের প্রত্যেককেই নিজের পয়সায় ধার-দেনা করে নিজেদের জায়গায় কাঠামো আর বেসমেন্ট বানিয়ে নিতে হচ্ছে। আমাদের খরচ হচ্ছে বর্গফুট প্রতি প্রায় ২৬০-২৭০ টাকা। সরকার আমাদের কোনো সাহায্যই দেয়নি।’
বাজারের বাইরে হাতিবাগান ফুটপাতে হোসিয়ারির কারবার যারা করত, তাদের অনেকে নিচে, আবার কেউ কেউ দোতালায় মাল রাখত। এরকম ক্ষতির সংখ্যাও প্রায় শ-খানেক। প্রায় ৩৫ বছর ধরে কেদারনাথ বস্ত্রালয়ের সামনে দোকান করেন হরেকৃষ্ণ দত্ত ওরফে কেষ্ট দা। বিধ্বংসী সেই আগুনে তাঁর তিন বস্তা মাল পুড়ে যায়। ক্ষতি প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। কথায় কথায় তিনি জানালেন কুলিরা অনেকে না থাকায় অনেকে মাল সেই দিন রাখেনি, ফলে অনেকের বেঁচে যায়। কিন্তু আমি আগের দিনই নতুন প্রায় চার হাজার টাকার মাল তুলেছিলাম, যার মধ্যে এক হাজার টাকা একজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে। আজকাল মহাজনেরা আর বাকিতে মাল দেয় না। নগদে আনতে হয়। এইতো বাজার থেকে সুদে টাকা নিয়ে এই নতুন মাল কিনতে হল। মাত্র পাঁচ-ছ দিন হল এখানে আলো এল। তাই চৈত্রমাসের সেলের বাজার আমরা করতে পারিনি। অন্ধকারে কী করে দোকানদারি করব বলুন। আমাদের তো ফুটের দোকান তাই মহাজনেরা ধার দেয় না। যাদের পার্মানেন্ট দোকান আছে তাদের দেয়।
আগে অনেক হকার ইউনিয়ন নেতা ছিল (বিশ্বনাথ গোস্বামী, নলিনী গুহ, হেমন্ত বসু প্রমুখ) যাদের দৌলতে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক বা অন্য কেউ লোন দিত। (১৯৮৫-৮৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত) এখন আর সেসব পাওয়া যায় না। আমাদের এখনকার ইউনিয়ন, সরকারে যারা আছে তাদের। যারা সরকারে থাকে তাদের ইউনিয়ন না করলে তো বসতে পারব না। তাই যখন যে ক্ষমতায় সেই দলের ইউনিয়ন করি। সরকারের সাহায্যের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাইনি।
শ্রীমান চক্রবর্তী, হাতিবাগান বাজার, ৩০ এপ্রিল
Leave a Reply