রেহানা বারোই, কোচবিহার, ২৯ মার্চ#
রক্তদান শিবির নয়, ব্লাড গ্রুপ কমিউনিটি তৈরি করে একে অপরের অসুস্থতায় সরাসরি রক্ত দিয়ে সহায়তা করুন — এই আমাদের লক্ষ্য। সেরকমই একটি ক্যাম্প করার উদ্দেশ্যে আমাদের টিম রওনা দেয় ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে। আমাদের প্রথম কাজ গ্রামের সকলের ব্লাড গ্রুপ শনাক্ত করে রেজিস্টার করা এবং গ্রামের একজনের কাছে সেই রেজিস্টার থাকবে, যে পরবর্তীতে রেজিস্টার দেখে প্রয়োজনীয় রক্তের জোগানের ব্যাপারটা পরিচালনা করবে। কিন্তু সেই পরিচালক আবদুল্লা ভাই জানান, আপা আজি সগায় ফম ফিলাপ করির যাবার ধরছে, সেন্টাল সরকারের মানসি আইচ্চে। আমি জিজ্ঞেস করলাম — কীসের ফর্ম? আবদুল্লা ভাই জানান, এনএসডিএল-এর ফর্ম। এক লাখ টাকা করি ইনস্যুরেন্স দিবে।
কিন্তু সব শুনে ব্যাপারটায় খটকা লাগল। এনএসডিএল-এর নাম জানি। কিন্তু তারা তো ট্যাক্স সংক্রান্ত কাজকর্ম করে। ইনসিওরেন্স কোথা থেকে এল? উত্তমদাকে সাথে নিয়ে সেই সেন্ট্রাল সরকারের কর্মচারীর কাছে গেলাম। দু-জন ছেলে বসে বসে ফর্ম ফিলাপ করছে। দারিদ্র্য ও বেকারির যন্ত্রণার ছাপ তাদের চোখে মুখে। সকলের কাছ থেকে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড ও দু-কপি করে পাসপোর্ট সাইজ-এর ছবি নিচ্ছে। এতকিছুর মধ্যে কারো ছবি যদি না থাকে, তাহলে ক্যামেরা দিয়ে তারা ছবি তুলে নিচ্ছে, তার বিনিময়ে কুড়ি টাকা করে নিচ্ছে। এবং যদি কারোর কাছে জেরক্স না থাকে তাহলে তারা স্ক্যানারে স্ক্যান করে নিচ্ছে। আয়োজন দেখে মনে হল, এ সেন্ট্রাল সরকার নয়। তার থেকেও বড়ো কোনো সরকার।
কিন্তু খটকা লাগলো, আধার কার্ড না থাকলে ফর্ম ফিল-আপ হচ্ছে না। ফর্ম ফিল-আপের পর গ্রামের মানুষকে একটি সাদা কাগজে লিখে দিচ্ছে। যার নামে ফর্ম, তার নাম ইংরেজিতে ও তার পাশে @gmail.com আর বলছে, এটা হারাবেন না, এটা হারালে আই কার্ড পাবেন না। প্রশ্ন করলাম, ভাই এটা সেন্ট্রাল সরকারের কোন প্রজেক্ট? তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারল না। উল্টে খানিক মেজাজের সুরে কথা বললো। বললাম,
— আপনাদের ফর্মে তো কোথাও কেন্দ্রীয় সরকারের কথা লেখা নেই?
— কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের কোম্পানিকে এই কাগজটা দিয়েছে।
— ও আচ্ছা, আপনাদের একটা ফর্ম নিতে পারি?
— না।
উত্তমদা ততক্ষণে ওর মোবাইল ক্যামেরায় ফর্মের ছবি তুলে ফেলেছে।
এরপর সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করি ও ব্যাপারটা খুলে বলি। উনি সব শুনলেন ও বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলের একজন রাঁধুনিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। রাঁধুনির কথা শুনে পুরো ব্যাপারটা বোঝা গেল — এখানে কোনো ভাঁওতাবাজি রয়েছে। রাঁধুনিদিদি জানালেন যে, এনএসডিএল-এর কার্ড বানালে সকলে এক লাখ টাকা বীমা পাবেন বিনামূল্যে। যদি কোনো ছোটোখাটো অসুস্থতায় ভোগেন গ্রামবাসী, যেমন কারো জ্বর, সর্দি-কাশি বা পা ভেঙে যাওয়া, তাহলে কোচবিহার শুভম নার্সিং হোম-এ চিকিৎসা হবে বিনামূল্যে। যদি কারো বড়ো কোনো অসুখ, যেমন ক্যান্সার বা কোনো বড়ো অস্ত্রোপচার হয়, তাহলে সরকার থেকে অর্থসাহায্য পাবেন। এছাড়াও যাদের এনএসডিএল কার্ড থাকবে, তারা যে কোনো চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। এই কার্ড জাতি ধর্ম বিপিএল তপশীল নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রযোজ্য। প্রধান শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, তারা স্কুলে না এসে মসজিদের সামনে বসলেন কেন? রাধুনি বললেন, ওরা নাকি স্কুলে এসে ঘুরে গেছে। শিক্ষকরা বসতে দেননি। প্রধান শিক্ষক অবাক হলেন। এবার তিনি ওই ব্লকের জয়েন্ট বিডিওকে ফোন করে ব্যাপারটা জানলেন। যুগ্ম ব্লক আধিকারিক জানালেন, আমাদের এমন কোনো প্রজেক্ট নেই। আমি এক্ষুনি ওই এলাকার প্রধানকে বিষয়টা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য বলছি। প্রধান শিক্ষককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমাদের কাজ হল না। আবদুল্লা ভাইকে বললাম, পরের শনিবার আমরা ক্যাম্প করব।
আসার পথে আরও চারটি জায়গায় এমন ঠেক দেখতে পেলাম। এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে একজন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বলল, দিদি এটা ই-ইনসিওরেন্সের ফর্ম ফিল-আপ চলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন কোম্পানির? সে বলল, এটা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রজেক্ট। জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনাদের কত টাকা করে দিবে বলেছে?
— প্রতি ফর্ম তিন টাকা করে।
— আপনি কতগুলো ফর্ম করেছেন?
— তা দিদি দশ হাজারের ওপারে।
— তার মানে ত্রিশ হাজার।
— না দিদি, আমরা দশজন মিলে পুরোটা করছি।
তখনই আবদুল্লা ভাই-এর ফোন এল। আমরা ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আবদুল্লা ভাই-এর ফোনে সাড়া দিলাম। আবদুল্লা ভাই খুব উৎফুল্লতার সঙ্গে জানালেন, আপা প্রধান সাহেব পঞ্চায়িতকে ফোন করছিলি, পঞ্চায়েত চ্যাংড়া গুলাক তুলে দিছে। আমি বললাম, ঠিক আছে ভাইজান।
যেতে যেতে ল্যাব অ্যাসিট্যান্ট পুনম ওর মোবাইল থেকে ফর্মে দেওয়া ওয়েবসাইটের পেজ খুলে দেখল, এনএসডিএল একটি ডাটাবেস ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। বুঝলাম, এরা ডাটা বিক্রি করে ও আরও ভাবলাম এরা আধার কার্ড ছাড়া ফর্ম ফিল-আপ করছে না। তাহলে তো আধার কার্ডের ডাটাই আসল, আর সেখানে তো একজন মানুষের সবরকম তথ্যই রয়েছে। ভেবে শিউরে উঠলাম। কার প্রয়োজন এই আধার কার্ডের ডাটা? কোথায় পাচার হচ্ছে এই ডাটা?
Leave a Reply